একে তো ভাষার জন্য এমন আন্দোলনের নমুনা পৃথিবীর কোথাও নেই, তার ওপর অধিকার আদায়ের দাবিতে ছাত্রজনতার অনন্য প্রতিবাদ; এই দুইয়ের সমন্বয় ৫২র ভাষা আন্দোলনকে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছে। আর ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা‘ গেয়ে স্বাধীকার আন্দোলনের এক চিরন্তন সবক এ দেশের মানুষ এই মহান আন্দোলন থেকেই পেয়েছে। কাজেই, আজো যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলতে গেলে আমাদের বারবার একুশের দিকে তাকাতে হয়।
ভাষা আন্দোলন মুখ্যত ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জি.এস অধ্যাপক গোলাম আজম বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে প্রথম স্বারকলিপি প্রদান করেন । পরবর্তীতে সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, ভাষা সৈনিক আব্দুল গফুররা বলিষ্ঠভাবেই সে সময় ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের আঞ্জাম দিয়েছেন। তারা আমাদের সবক দিয়ে গেছেন কী করে রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে মায়ের ভাষাকে বুকে আগলে রাখতে হয়। সালাম,জব্বর,রফিক,বরকতেরা শিখিয়েছেন কিভাবে ন্যায্য দাবিকে ঘিরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষে নিয়ে যেতে হয়।
৫২র পর থেকে অধিকার আদায়ের চেতনা যেন ছাত্রজনতার রক্তে মিশে গেছে। যার ফলে পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। যদিও বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বার্থের কলুষ যুক্ত হয়েছে, কিন্তু ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তি গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনের অধ্যায়ে ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তা কারোর মাথায় এসেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। যদিও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আজ নানান বিতর্ক, কিন্তু এই স্বপ্নও অনেক মানুষ দেখেন যে গণতন্ত্র রক্ষা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়ে যাবে।
একুশের আন্দোলনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সে সময় ছাত্ররা সাহস করে সত্য বলার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানি শাষকদের নির্যাতন, প্রলোভন কোন কিছুই ছাত্র নেতাদের আন্দোলনের চলমান পথ থেকে একচুল বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে রাজপথ বুকের রক্তে ভেসে গেলেও, চলে যায়নি মুখের সাহসী উচ্চারণ।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা পরবর্তীতেও আমরা পরিস্কার দেখতে পাই। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র সমাজ অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল। ছাত্রনেতা আসাদ (শহীদ আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান) আজো গণতান্ত্রিক যে কোন আন্দোলনের প্রেরণা। আইয়ুবশাহীর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁর জীবন দান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই স্থান পেয়েছে। শুধু ছাত্রনেতা আসাদ নয়, আইয়ুবশাহীর পতন ঘটাতে সে সময় সাধারণ ছাত্ররা যেভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল, তা সত্যিই বিষ্ময়কর। এমনকি দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরও বুক পকেটে মা‘কে লেখা চিরকুট নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু বাংলার আপামর জনসাধারণকে যেমন কাঁদিয়েছিল, তেমনি মানুষকে নতুন করে আন্দোলনের শপথে বলীয়ান করেছিল।
জাতীয় নেতাদের অনেককেই আইয়ুব সরকার কারাবন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকেনি। ছাত্রনেতারা সামনে থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রকামী মানুষেরা ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল। মানুষের মনে সে সময় এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবেই ছিল যে ছাত্ররা আন্দোলন করছে মানে সে আন্দোলনের শতভাগ যৌক্তিকতা রয়েছে। কাজেই, আপামর জনসাধারণ আন্দোলনে অংশ নিতে কোন কুণ্ঠা বোধ করেনি। আর সেজন্যই আমরা গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের তালিকায় গৃহবধু, কৃষক, শ্রমিকসহ নানান পেশার মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাই।
আমরা যদি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের আগের ইতিহাসের দিকেও তাকাই, তাহলেও ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জল ভূমিকা দেখতে পাব। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬২র শিক্ষা আন্দোলনেও ছাত্র সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অবদানের কথা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হবার আগ থেকেই সচেতন ছাত্রসমাজ স্বাধীনতার জন্য কাজ করে আসছিল। সে সময়ের ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রবদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তলন উদ্বোধন করেন। শ্লোগানে-মিছিলে আওয়াজ তুলে ছাত্রসমাজই সারাদেশে মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাগরণ তৈরি করেছিল।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে জাতীয় নেতাদের পথচলার পেছনে আমরা ছাত্রনেতাদের স্পষ্ট ভূমিকা দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধের সসস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রসমাজ কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে, তখন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, তা সসস্ত্র সংগ্রামকে আরো বেগবান করেছিল। যুদ্ধের নয় মাসে ছাত্রসমাজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে থেকে বাংলার মানুষকে সাহস যুগিয়েছে, সব বাধা মোকাবেলা করে বিজয়ের কাঙ্খিত লক্ষে পৌছানোর স্বপ্নে মানুষকে বিভোর রেখেছে।
১৯৯০ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যে সফলতার মুখ দেখেছিল, এর পেছনে ছাত্রসমাজের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে। ৮২ সালে সামরিক বাহিনী থেকে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ছাত্রসমাজ গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে রাজপথে সোচ্চার ছিল। এরশাদ রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক ছাত্র হত্যা চালিয়ে যায়। ১৯৯০ এর অক্টোবর মাসে যখন ছাত্রনেতা নাজিমউদ্দিন জেহাদ শহীদ হন, তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এরপর থেকেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সাফল্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। ডা. মিলনসহ বেশ ক‘জনের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। মূলত, ১৯৯০সালের ১০ অক্টোবর গড়ে উঠা ছাত্র আন্দোলনের সফলতাই বাংলাদেশকে তখন স্বৈরাচার মুক্ত করে।
কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ছাত্রজনতা অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। একদিকে এই সরকার ব্যবস্থার রুপকার অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াত-শিবির যেমন এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বের আন্দোলনেও ছাত্ররা ভূমিকা রাখে। যার ফলে আমরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে তত্তাবধায়ক সরকারের এক সুন্দর ব্যবস্থা পাই। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
পরবর্তীতেও আমরা ছাত্রসমাজের কিছু ভূমিকা দেখেছি। কিন্তু অতীতের তুলনায় তা ছিল অনুজ্জল। ছাত্র সংগঠনগুলো হারিয়েছে স্বকীয়তা, লেজুড়বৃত্তিতে ছাত্র রাজনীতি আজ কলুষিত হয়ে পড়েছে। ভাষা আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পরবর্তীতে, আজ তা মনে করে আমাদের আফসোস করতে হয়।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াত ইসলামীর সমাবেশ সমাবেশ পন্ড করতে এসে পল্টন মোড়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যখন জামায়াত-শিবিরের নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর অস্ত্রসহ হামলা চালিয়েছিল, তখনও কিন্তু আমরা এক ঝলক একুশের ধারাবাহিকতা দেখতে পেয়েছি। শহীদ মুজাহিদ, শিপনরা সেদিন জীবন দিয়ে সন্ত্রাসীদের কালো থাবা কী করে প্রতিরোধ করতে হয় তার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখে গেছেন।
যখন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বিচারিক হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তখন থেকে বাংলাদেশে আমরা ছাত্রজনতার গণজাগরণ দেখতে পেয়েছি। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া সাজানো রায়ের পর ছাত্রজনতা সারা বাংলাদেশে যে আন্দোলনের নমুনা পেশ করেছে, তাও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শতাধিক ছাত্রজনতা একই দিনে অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে যেভাবে নিজেদের জীবন দিয়েছে, তা পাঠ করে ভবিষ্যতের ছাত্রজনতা আত্মত্যাগের প্রেরণা খুঁজে পাবে।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় যেমন দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর শহীদ হয়েছে, তেমনি ভাবে ৩ ডিসেম্বর ২০১২ সাম্প্রতিক সময়ে দিনাজপুরে দশম শ্রেণীর ছাত্র মুজাহিদ শহীদ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, ইতিহাসবীদদের সত্য লেখনিতে একদিন মুজাহিদের নামও মতিউরের মত উজ্জল হয়ে উঠবে।
৯১ সালের পর থেকে আমরা একের পর এক গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে পেলেও দু:খজনকভাবে কোন সরকারই ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের ধারাাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়ে ওঠেনি। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রয়েছে। ফলে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে সঠিক ব্যক্তি উঠে আসছে না। আর সেজন্যই আমরা দেখছি সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজ পরবর্তীতে আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, তা থেকেই বর্তমানে আমাদের প্রেরণা নিতে হবে। প্রতিটি আন্দোলন থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছুই রয়েছে। কী করে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে ভয়হীন হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, কী করে আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে একত্রিত করতে হয়, এসব আমরা একুশ ও পরবর্তী আন্দোলনগুলো থেকে শিখতে পারি।
ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের পাঠ আমাদেরকে বলে, একুশের সংগ্রামীরা যুগের পর যুগ মানুষের জয়গান গেয়ে গেছে। একুশ যে ছাত্রসমাজের মাঝে যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে, তা আজো সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে আছে। কাজেই, বর্তমানের আওয়ামী অপশাসন বিরোধী আন্দোলনে আমাদের একুশের প্রেরণা নিয়েই ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। কোন আন্দোলনই গাছ থেকে পাকা ফল পাওয়ার মত সহজ নয়। আন্দোলনের পথে অনেক বাধা আসে, সব মাড়িয়েই ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলে একদিন সফলতার দেখা মেলে।
আজ শাসকের নামে যারা শোষক হয়ে বসে আছে, গণতন্ত্র হরণ করে বাকশাল কায়েমের পায়তারা করছে, তাদেরও একুশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শোষণ করে ক্ষমতায় টেকা যায় না, এ সত্য ইতিহাসের পাতায় স্পষ্ট প্রতীয়মান। এভাবে শোষণের পথ ধরে হাঁটতে থাকলে শুধু আওয়ামীলীগ নয়, যে কোন শাসকেরই পতন অবধারিত।
সবশেষে বলতে চাই, একুশ থেকেই আমরা জানি- ছাত্রজনতা সবই পারে। আজকের জালিম শাসক যদি স্বেচ্ছায় মসনদ থেকে সরে না দাঁড়ায়, তাহলে আগামী দিনে ছাত্রজনতা তাদেরকে চরম শিক্ষা দেবে। শুধু সময়ের ব্যাপার, ছাত্রজনতার জয় হবেই ইনশাআল্লাহ।