বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

বর্ষবরণ: অপসংস্কৃতিই যেন হয়ে উঠেছে সংস্কৃতি


                                                                মনির আহমেদ

বর্ষবরণ এখন যেন আর বর্ষ বরন নেই। তা যেন হয়ে উঠেছে উলঙ্গ উন্মাদনার এক মাধ্যম। এক ধরণের নোংরামি করে স্বরণীয় করে রাখার দিন। অন্যায় থেকে ফিরে থাকার শপথ নেয়ার পরিবর্তে অনেকে অনৈতিকতা আর নোংরামি দিয়ে শুরু করতে চায় দিনটি। বাঙ্গালী সংস্কৃতির চর্চার নামে মূলত এই সংস্কৃতিরই বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। নিজ সংস্কৃতির বিসর্জনে অপসংস্কৃতিই হয়ে উঠেছে বরণীয়।
বর্ষবরণের মত অনুষ্ঠান গুলোতে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে আমার খুব একটা যাওয়ার সুযোগ হয় না। ১লা বৈশাখ সাভারে গিয়েছিলাম। ব্যাক্তিগত কাজে। শুরুতেই আমাকে সময় দিয়েছেন আলাউদ্দিন ভাই। এরপর দেখা করি সাভার মডেল কলেজের অধ্যক্ষ জনাব তৌহিদুল ইসলাম স্যারের সাথে। যদিও তিনি স্যার, তবে আমার সাথে উনার সম্পর্কটা অনেকটা বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মত। অনেক বিষয়ে আলাপ করলাম। এক পর্যায়ে একটি পরামর্শও দিয়ে আসলাম। ‘আপনাদের কলেজের অনেক সুনাম সুখ্যাতি। আপনি চাইলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যা সর্বমহলে প্রসংশিত হবে।’
তৌহিদুল স্যার হাসলেন। বললেন, চিন্তা আছে।
মাহবুব ভাই, হাসান ভাইসহ কাজ শেষ করে যখন ফিরছিলাম, হেলাল ভাইকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চক্কর দেয়ার লোভ জাগলো। হেলাল ভাইসহ মোটর সাইকেল নিয়ে ঢুকলাম। আসলেই অনেক সুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে একটি হল আছে, যেটি কিনা এশিয়ার সর্ববৃহৎ হল! মীর মোশারফ হোসেন হলটি দেখতে বেশ সুন্দর। পনেরো শ’র বেশি ছাত্র থাকতে পারে এই হলে। এক এক করে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। হেলাল ভাই অনেকটা গাইড এর ভূমিকায়।
চারুকলার তত্ত্বাবধানে সাং¯কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। অনেক দর্শক বসে দেখছেন। সবার মাঝে একটা নতুন নতুন ভাব। গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা। কেউ লাল-সাদা শাড়ি, কেউ সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে। হাতে ফুল মাথায় ফুলের বেনি, অনেকে এসছেন ছেলে মেয়েদের নিয়ে। এত সুন্দর ফুটফুটে ছেলে মেয়েদের দেখলে অনেক সময় লোভ হয় একটু কাছে যাই কোলে তুলে নেই, একটু আদর করে দেই। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন কিছু দেখানোর জন্য, কিছু শেখানোর জন্য। কিন্তু আসলে আমরা কী দেখাচ্ছি আর কী শেখাচ্ছি আমাদের সন্তানদের?
আমরা শিশুদের দেখাচ্ছি কীভাবে প্রেম-ভালোবাসার নামে বর্ষবরণের দিনেও বিশ্রীভাবে জোড়ায় জোড়ায় বসে কী করে আড্ডা দিতে হয়। কীভাবে পর পরুষ হয়েও মহিলাদের দিয়ে নিজের শরীরের উল্কি আকার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হতে হয়। রিক্সায় করে কীভাবে জোড়া মিলিয়ে ঘুরাঘুরির নামে নেশা খোরের মত সময় অতিবাহিত করতে হয়। পান্তা-ইলিশের নামে  কীভাবে সমাজে বৈষম্য তৈরির রাস্তাকে উন্মুক্ত করে তুলতে হয়। কীভাবে হোলি খেলার নামে রং মাখামাখি করে ছেলেমেয়েদের অন্যায় ছোঁয়াছুঁয়িতে মেতে উঠতে হয়।
বর্ষবরণের উদযাপনে দেখছি কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। রং হাতে নিয়ে আছে। সামনে কেউ হেটে যাচ্ছে, তার শরীরে রং মাখিয়ে দিচ্ছে খুব আলতো ভাবে। ছেলেও নিষেধ করছে না। একজন মেয়ের আলতো হাত শরীরে লাগছে, এটাতো কারো কারো কাছে অনেক বড় পাওয়া। এর ফলে কী হচ্ছে? স্পষ্টতই, সমাজে অনৈতিকতার চর্চা বেড়ে যাচ্ছে।
সন্ধায় যখন ফেইজবুক লগ ইন করলাম দেখি বন্ধুরা বিভিন্ন পত্রিকার লিংক শেয়ার করেছেন। ছাত্রী উত্যক্ত করার অপরাধে চানখারপুলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর, ছবি তুলতে চেষ্টা করায় ছাত্রলীগ কর্মী কর্তৃক সাংবাদিককে নাজেহাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ৩০/৩৫জন ছেলের একটি দলের দর্শনার্থী কয়েকজন মেয়েকে বিবস্ত্র করে অন্যায় আবদার পুরণের চেষ্টা
এবং এই কাজে বাধা দিতে গিয়ে আহত কয়েকজন, এক ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে বিবস্ত্রকরণ। আমরা ভুলিনি ১৯৯৯ সালে এরকম বর্ষবরণে রাত ১২.০১ মিনিটে বাঁধনকে বিবস্ত্র করার কথা। যদিও সংসদে দাঁড়িয়ে তখন জয়নাল হাজারীর মত ব্যক্তি উল্টো বাঁধনেরই বিচার দাবি করেছিলেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে হিং¯্র জানোয়ারের ছবি, কার্টুন, ঢোল, তবলা, বাঁশিই যেন আমাদের মূল সংস্কৃতি!
অথচ শৈশবে দেখেছি ঠিক এর উল্টো চিত্র। নতুন বছরকে বরণ পুরাতন বছরকে বিদায় জানানোর উদযাপনে ছিল ভিন্ন আমেজ। এই দিনে সকাল বেলা মা বোনেরা কোরআন পড়ে শুরু করতো। অন্য দিন কোরআন না পড়তে পারলেও এদিন সবাই পড়তো। চিন্তা থাকতো আজ সারাদিন কারো সাথে কোন খারাপ আচরন করবে না, কাউকে দেখতাম রোজা রাখতে, কেউ রাত জেগে নামাজ পড়তেন। ইচ্ছা থাকতো গত বছরে জেনে না জেনে যে অন্যায় করেছি, মিথ্যা বলেছি, মানুষের অধিকার নষ্ট করেছি, তা থেকে মুক্ত হতে হবে। এজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো, প্রতিজ্ঞা করতো নতুন বছরে এসব থেকে বেঁচে থাকার। মসজিদগুলোতে দোয়ার আয়োজন করা হতো। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা পুরাতন হিসাবের খাতা বাদ দিয়ে নতুন হিসাবের খাতায় লিখা শুরু করতো। হিসাব চুকিয়ে ফেলার জন্য হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো।  মানুষের মাঝে লেনদেন পরিশোধ করার জন্য এক ধরনের পেরেশানি লক্ষ্য করতাম। এসবই ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
 কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমরা অতি আধুনিক হতে শুরু করেছি। বর্ষবরণ মানেই যেন নোংরামী। আমরা যেন এক নোংরা খেলায় মেতে উঠেছি। অতীত ঐতিহ্যকে হারিয়ে অনৈতিকতার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি।
 সচেতন যুব সমাজকেই এর জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবর্তনের আওয়াজ তুলতে হবে। আমরা নোংরামী চাই না, বৈষম্য চাইনা, অনৈতিকতা চাইনা, মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন দেখতে চাইনা। সংস্কৃতির নামে অসুস্থ্যতার সয়লাব দেখতে চাই না।
আসুন আমরা বাংলাদেশের আকাশে ভূতের মতন চেপে বসা অপসংস্কৃতিকে দূর করে সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতিকে আপন করে নেই। নববর্ষসহ জাতীয় দিবসগুলোকে নিজ সংস্কৃতির আলোকে উদযাপন করে অর্থবহ করে তুলি।

লেখক: সাংবাদিক

1 টি মন্তব্য:

  1. চেতনা, বাঙ্গালী রমনীদের ল্যাংটা করে কাপড় কেড়ে নিলেও কোটি বছরের বাঙ্গালীর সংস্কৃতি কিন্তু কেড়ে নিতে পারি নি।।
    "জয় বাংলা"
    সব চেতনায় আমরা

    উত্তরমুছুন