মনির আহমেদ
বংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অওয়ামীলীগের চরিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করে। অথবা বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এই দলটির আসল চরিত্র জনগণের সামনে প্রকাশ পেতে শুরু করে। ক্ষমতাই আওয়ামীলীগের একমাত্র লক্ষে পরিণত হয়। এখন এসে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে হত্যা করেই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।
১৯৪৯ সালে ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ নামে যাত্রা শুরু করে এই সংগঠনটি। তখন সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয় টাঙ্গাইলের সামসুল হককে। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি নাম থেকে বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ করা হয়। তখন দলে মতানৈক্য দেখা দিলে ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৫৪ সালে একবার যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতার খানিকটা স্বাদ পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও ১৬৭ আসন পায় দলটি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।
২৫ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৪৬, জামায়াত ৩ ও স্বতন্ত্র ২টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগ।
জনগণের ওপর জুলুম-নিপিড়নের কারণে ২০০১ সালে ভরাডুবি হয় তাদের। ২০০৭ সালে নাটকীয় ১/১১ কে পুঁজি করে ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ।
এবার তারা ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে থাকে। একদিকে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার, অন্যদিকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধের নামে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যার মিশন। সাথে সাথে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। শুরু হয় প্রতিবাদ, কিন্তু কোন ভাবেই তারা কারো কথাকে পাত্তা দিচ্ছেনা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই নির্বাচন কমিশনের অধীনে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দল অংশগ্রহন না করে তত্ত্বাবধায়কের দাবি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
২৯ ডিসেম্বর ১৩’ মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ঘোষণা করে দেশের মানুষকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। বিক্ষুব্ধ জনতা যেন ঢাকা ঢুকতে না পারে সেজন্য সরকার ঢাকার চারিদিকে বাধার প্রাচীর তৈরি করে। সকল বাধা পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ খালেদার আহ্বানে ঢাকায় আসেন। সেদিন সকাল থেকেই সারা ঢাকায় অনেকটা অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর একটা অংশকে দেখলাম মাইকিং করতে। ‘আপনারা কেউ রাস্তায় বের হবেন না।’
যেখানে কোথাও ৫/৭জন একত্রিত হচ্ছে, সেখানেই পুলিশ তাড়া দিচ্ছে, গুলি করছে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষের হয়রানি। কী এক বিড়ম্বনা! মানুষের কথা বলার কোন স্বাধীনতা নেই, রাস্তায় অভয় নিয়ে চলার কোন ফুরসত নেই। শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারাদেশে হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার করা হয়।
বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সারাদেশে চরম বিরোধীতার মধ্য দিয়ে নামমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। যাতে ৫ শতাংশ ভোট পড়ে, যদিও সরকার পরে সেটিকে ৪০ শতাংশ দেখায়। সবচেয়ে হাস্যকর হলো প্রায় ৫৩ টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি।
তারপরও শতভাগ আসন পাওয়ার উল্লাস করে ক্ষমতাসীনরা। কোন বিরোধী দল নাই, যারা আছে তারা সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। বাহ! কী চমৎকার!
দীর্ঘ দিনের জুলুম-নির্যাতন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠে বিরোধী দল। তারা সরকারকে কিছুদিন সময় দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলন শুরু করার চিন্তা করে আবার। এভাবে কেটে যায় এক বছর। এ বছরের ৫ জানুয়ারি অবৈধ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। সরকার কোন ভাবেই করতে দিবেনা। পুলিশের অনুমতি মিলেনি সহিংসতার অজুহাতে। বেগম খালেদা জিয়া অনড় থাকেন, তিনি বের হবেন অফিস থেকে। সমাবেশ করবেনই। সারাদেশ থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় আসে। এক পর্যায়ে খালেদা বের হওয়ার পরিকল্পনা করেন, অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসেন। কিন্তু তার অফিসের গেট আটকে রাখা হয়। পুলিশের বেরিকেড ভেঙ্গে ভেতর থেকে গেট খোলার চেষ্টা চলে। সাথে সাথে পুলিশের পিপার স্প্রে নিক্ষেপের ফলে খালেদা জিয়াসহ অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বের হতে না পেরে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে অহ্বান জানান খালেদা জিয়া। অররোধের ঘোষণা দেন তিনি।
সেই থেকে খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ থাকেন তার অফিসে। অবরোধ, হরতাল ৯৩ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। হরতাল অবরোধে এই সময়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন রাষ্ট্র সরাসরী সরকারকে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধান করার আহ্বান জানালেও সরকার কর্ণপাত করেনি। বরং উল্টো সৈয়দ আশরাফ মন্তব্য করে বসলেন, ‘দুই আনার মন্ত্রী, কাজের মেয়ে মর্জিনা।’ কে না বোঝে এসব ছিল সম্পূর্ণ শিষ্ঠাচার বহির্ভূত।
৬ এপ্রিল কালের কন্ঠের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, এফবিসিসিআই এর হিসাব মতে দেশে প্রতিদিন অবরোধে প্রায় ক্ষতি হয় দুই হাজার সাত শত কোটি টাকা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাব মতে দিনে ক্ষতির পরিমান দুই হাজার দুইশত আটাত্তর কোটি টাকা, যা অবরোধকালিন সময়ে প্রায় দুইলাখ কোটি টাকার বেশী।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এত পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্যেও সরকারের মাথা ব্যাথা হয়নি। একটা বিষয় স্পষ্ট, যদিও আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেছে, কিন্তু তারাতো জানে জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত নয়। সুতরাং জনগণের ক্ষতি হলেও তাদের কোন সমস্যা নেই।
এই সময়ে খালেদা জিয়ার ওপর চলে মানসিক নির্যাতন। মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়া হয়, যদিও তারা তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর তার মামলার দায়ভার হিসাবে স্ত্রী, কন্যাদের আসামী করা হয়। কোন পথেই যখন আন্দোলন থেকে ২০ দলকে ফেরানো যাচ্ছিল না, তখন সরকার ঘোষণা করে তিন সিটি নির্বাচন।
অনেকটা হঠাৎ করেই খালেদা জিয়া ৫ এপ্রিল আদালত থেকে জামিন নিয়ে গুলশানের বাসায় যান। রাজনীতিতে অনেকটা স্বস্তি আসে, তিন সিটিতে হরতাল-অবরোধ শিথিল করা হয়। যদিও গুঞ্জন আছে সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই এই নির্বাচনে যাওয়া ও আন্দোলন থেকে সরে আসা। যাক, সেটি ভিন্ন আলোচনা।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ তখন থেকেই ঘোষণা দিতে থাকেন খালেদা জিয়া নির্বাচনে ঢাকায় চষে বেড়াবেন। আস্তে আস্তে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় অনেকটা অজান্তেই। নির্বাচনে মির্জা আব্বাস, তাবিথ, মঞ্জুরের মননোয়ন বৈধ হওয়ায় নির্বাচনে কাজ শুরু হয়। পরিবেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।
খালেদা জিয়াও পরিকল্পনা অনুযায়ী গণসংযোগ শুরু করেন। গাত্রদাহ শুরু হয় আওয়ামী নেতা কর্মীদের। আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ড.হাসান মাহমুদ ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া গণসংযোগে বের হলেই তাঁকে ঘেরাও করা হবে। পরবর্তীতে অন্য আরেকটি পোগ্রামে তিনি বলেন, ঘেরাও করে ধোলাই দেয়া হবে। অন্যদিকে আওয়ামী বুদ্ধীজীবি মহল একটি পোগ্রাম থেকে জানতে চান, খালেদা জিয়া কোন হিসাবে গণসংযোগ করছেন । স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বাস পুড়িয়ে কীভাবে বাসে ভোট চান। খালেদা জিয়াই তাদের জন্য চক্ষুশুল!
১৯ এপ্রিল খালেদা জিয়া যান উত্তরায় গণসংযোগে। সেখানে আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কালো পতাকাসহ হামলা করে তার গাড়িবহরে। তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, খালেদা গণসংযোগ শেষে ফিরে আসেন।
২০ তারিখ তিনি কাওরান বাজারে যান। গণসংযোগের এক পর্যায়ে সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন গাড়ির পার্শ্বে দাঁড়িয়েই। হঠাৎ আক্রমন করা হলো গাড়িবহরে। খালেদা জিয়া গাড়িতে ঢুকে যান। পুলিশের উপস্থিতিতে ভাঙচুর করা হয় অর্ধশত গাড়ি। আহত হন সিএসএফ কর্মকর্তাসহ ১২ জন, মাথায় আঘাত পান ৫ জন। সে দৃশ্য যে কাউকে আতঙ্কিত ও বিচলিত করবে।
কিছুক্ষণ পরেই প্রধানমন্ত্রীর একটা বক্তব্য সবার নজরে এসেছে। তিনি বললেন, ‘সিএসএফ এর কোন অধিকার নেই গুলি করার। সব খালেদার নাটক। আর কত নাটক করবেন। আর কত জনগনের রক্ত নিয়ে খেলবেন।’ বাহ! কী চমৎকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য!
স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বললেন হামলার জন্য সিএসএফ দায়ী। প্রধানমন্ত্রী তনয় জয় বললেন জনগনের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। কী সুন্দর সব কথা!
২১ তারিখ খালেদা জিয়া আবার ভাঙ্গা গাড়িবহর নিয়ে বের হলেন গনসংযোগে। রাত ৮টার দিকে ফকিরাপুলে আবার গাড়িবহরে হামলা করা হলো। তিনি সেদিন আর কোথাও না গিয়ে বাসায় চলে যান।
২২ তারিখ আবার গনসংযোগে হামলা করে সরাসরি খালেদার গাড়ি ভাংচুর, গুলি করা হলো। সিএসএফ সদস্যদের রাস্তায় ফেলে সাপের মত পিটানো হলো। সাবেক পুলিশের আইজিপিসহ অনেককে আহত করা হলো।
অনেকে রক্তাক্ত হলো। হামলার ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হয় প্রথম দিন থেকে দ্বিতীয় দিন ভয়াবহ, ক্রমে এই হামলা আরো ভয়াবহ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন তাঁকে গণসংযোগে বাধা দেয়া হচ্ছে। কেন তার ওপর হামলা করা হচ্ছে? কেন গুলি করা হচ্ছে? কেন রক্তাক্ত করা হচ্ছে তার নিরাপত্তা কর্মীদের? কেন পুলিশের সামনে ঘটনা ঘটলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? কেন হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে একটি টিয়ারশেলও নিক্ষেপ করা হলো না? কেন ঘটনা ঘটিয়ে আবার আওয়ামীলীগ নেতা মামলা করে? কেন আবার শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়ে বলেন, এগুলো নাটক?
তাহলে জনগণ কি ধরে নেবে সরকার পাকিস্তানের বেনজির ভূট্টোর মত খালেদা জিয়াকে হত্যা করার চেষ্টা করছে? খালেদাকে হত্যা করেই ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার স্বপ্ন দেখছে?
লেখকঃ সাংবাদিক
সধযসবফপাপ@মসধরষ.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন