বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিন: যে স্মৃতি হৃদয়ে নাড়া দেয়

                                                             মনির আহমেদ
শহীদ আসাদুল্লাহ মাহফিলের সেচ্ছাসেবক হিসাবে

‘‘আমার কাছে মনে হয় আমার বাবা মরে নাই। সে সবসময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এখনো বলে, যাচ্ছি মা। আবার ফিরে এসে বলে, কী করছ মা। আমার চারপাশে ঘুরাঘুরি করে। মনে হয় এই বুঝি আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। আর আমি বলছি, সাবধানে যাস বাবা।’’
বলছিলেন শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিনের মা কমেলা বেগম। পুত্র হারানোর শোকে কাতর এই মা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। তবে এখনো তিনি বুঝতে পারেননি কেন তার সন্তানকে র‌্যাব তার চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে ।
গত ১৯মার্চ সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সাথে ছিলেন রাশেদুল হাসান ভাই। কয়েক দফা বাস পরিবর্তন করে পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা ছয়টা। পৌঁছে প্রিয় ভাই গোলাম মোস্তফা, তহুরুল ইসলাম সোহেলসহ পরিকল্পনা করি পরের দিনের শিডিউল নিয়ে- সকালে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, পরবর্তীতে শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিনের কবর জেয়ারত,  এরপরে অন্যান্য।
পরদিন পরিকল্পিত শিডিউল মেনেই কাজ শুরু হলো। প্রথমে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। এরপর এক বাসায় নাস্তা খেয়ে করব জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা দিই। গিয়েই দেখি আগে থেকেই আমাদের যাওয়ার খবর শুনে শহীদের সম্মানিত পিতা জনাব মো. একরামুল হক ও মামা কবির হোসেনসহ এলাকার অনেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেখেই প্রথমে শহীদের বাবাকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। শান্তনা ব্যর্থ হলো।
শহীদের কবর জেয়ারত
কবর জেয়ারত শেষে মোস্তফা ভাইকে বললাম, মায়ের সাথে দেখা করবো। বাসায় গেলাম। বাবা-মা এবং মামার কাছ থেকে শুনতে থাকলাম আসাদুল্লাহ তুহিনের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। তিন ভাই এক বোনের মাঝে তুহিন ছিলেন সবার ছোট। ছোট থেকে অতি আদরে বড় হয়েছিলেন। বড়ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর পারিবারিক বস্তবাতায় আর পড়াশোনা করতে পারেননি। মেজো ভাই এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর আর পড়তে পারেননি। সবার আশা ছিল তুহিন পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। তাদের বংশের মুখ উজ্জল করবে। সে জন্যই তাকে সব সময় সবাই নজরে নজরে রাখতো। সবাই সহযোগিতা করতো।
শহীদের মা বাবার সাথে লেখক
মামা জানালেন, ‘তুহিন টাকা চেয়ে পায় নাই এমন কোন ঘটনা আমরা ঘটতে দেইনি। মা বললেন, যত সমস্যাই থাকুক সে প্রতিদিন স্কুলে যেতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও কখনও কলেজ কামাই করতে তাকে আমরা দেখিনি। রওয়ানা দিয়েই বলতো, মা যাচ্ছি। আবার ফিরে এসে কী করছি জানতে চাইতো।’
বলতে বলতে মা’র চোখ থেকে জল গড়ায়। মা’র কাছে জানতে চাইলাম, এমন কোন আচরণ কি আপনার মনে পড়ে যা আপনাকে আনন্দ দিত।
মা বললেন, ‘তার বাবা অথবা আমি যদি কখনো কোন বিষয়ে বকা দিতাম, ধমক দিয়ে কথা বলতাম, সব সময় মাথা নীচু করে দাড়িয়ে শুনতো। কখনো উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতো না। গ্রামের কেউ বলতে পারবেনা যে সে কারো সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেছে। সবাই তাকে ভালোবাসতো। সেও সবাইকে শ্রদ্ধা করতো। ছোটদের আদর করতো। যে কোন সিদ্ধান্ত নিলে সে বিষড়ে সে অনঢ় থাকতো। তাকে কোন কাজ দিলে ঠিকভাবে করতো।’
মামা বললেন, ‘সে যে একাদশ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সিটি কলেজ শিবিরের সভাপতি ছিল, এটা আমিও জানতাম না। আর প্রথমে শুনেও বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ আমি জানি কলেজ সভাপতি হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়, এরা সিনিয়র হয়। মনে হয় প্রশাসনের কাছে এ দায়িত্বই তার বড় অপরাধ ছিল।’
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তুহিনের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। দেহ ছিল সুঠাম। তাকে অনেকে বলতো, তুমি তো সেনাবাহীনিতে দাঁড়ালেই টিকে যাবে। এসব জানলাম তার দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে।
তুহিন নিজেও নাকি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ সেবায় ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০১৩ সালে সে সেনাবাহিনীতে পরিক্ষা দিয়ে টিকেছিল। তখন তার কাছে সাড়ে চার লাখ টাকা চাওয়া হয়। তুহিন বলেছিল, আমার বাবা দরিদ্র মানুষ। এত টাকা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।
এর পর তুহিন চাকরির আশা ছেড়ে দেয়। ২০১৪ সেশনে আবার সেনাবাহিনীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সে আবেদন করে।
তুহিনের মামা কবির হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ একদিন সে আমার মোটরসাইকেলের সামনে দাড়িয়ে আমার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী হয়েছে? কেউ কি কিছু বলেছে? বললো, না। আবার জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো, মামা সেনাবাহীনিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, কিছু টাকা খরচ হলেও আপনি আমাকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেন। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আবেদন করো, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার কথা শুনে সে মহা খুশি। দুইতিন দিন পর বলে, মামা আমাকে ৪০০টাকা দেন। কেন জিজ্ঞেস করতেই বললো ২টা ট্রাউজার কিনবো। পাড়ার দুইজন গত বছর সেনাবাহিনীতে টিকেছে, তারা ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। এখন থেকেই তাদের কাছ থেকে ট্রেনিংয়ের বিষয়গুলো নিয়মিত দেখে নিতে পারলে পরে কষ্ট কম হবে। সেই আবেদনের পর গত ফেব্রুয়ারী মাসের ২ তারিখ ওর বাছাইয়ের জন্য রাজশাহী রেঞ্জে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। ২৭ জানুয়ারী ওর লাশ পাওয়া গেল হাসপাতালের লাশ ঘরে।’
এ বছরের ২৬ জানুয়ারী সকালে তুহিন মামার বাসায় গিয়েছিল মটোরসাইকেলের জন্য। কোথায় নাকি যাবে চিন্তা করেছিল। তারা তিন জন। মামা বলেছিলেন, এক জনের বেশী মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলে পুলিশ রাস্তায় আটকাবে। তাই তিনি সাইকেল না নিতে বলেন। সেখান থেকে এসে সারাদিন আর বের হয়নি তুহিন। অথচ ২০১৩-১৪ সালের এই সময়ে সে বেশীর ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতো। দেশের পরিবেশ ভাল ছিল না। সে সময় যে বাড়িতে প্রশাসনের লোক যেতো, কাউকে না কাউকে ধরে নিয়ে যেতো।
বেলা তখন পৌনে তিনটা। দুপুরে খাওয়া শেষ করে তার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল তুহিন। হঠাৎ বাসার সামনে এসে ২টা র‌্যাবের গাড়ি থামে। সাথে সাথে গাড়ি থেকে সবাই লাফিয়ে নেমে তুহিনের শোবার রুম ঘেরাও করে ফেলে। গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তন্ন তন্ন করে তাদের থাকার ঘর, পাকঘর সব খোঁজা হয়। র‌্যাব জামায়াত নেতা নূরুল ইসলাম বুলবুলের নাম লেখা একটি ক্যালেন্ডার ও ক্রিকেট খেলার ব্যাট, স্ট্যাম্প পায়। র‌্যাবের একজন বলে, বুলবুলের এক নম্বর লোক পাওয়া গেছে। এরপরই শুরু হয় তুহিনের ওপর নির্যাতন। সবার সমানে স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে মারতে তিনটা স্টাম্পই ভেঙ্গে ফেলে। র‌্যাব সদস্যরা জিজ্ঞেস করে, কোথায় অস্ত্র রেখেছিস বল? তুহিন বলে, আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই। র‌্যাবের একজন তুহিনদের গাছ থেকে লেবু পেড়ে বলে, এখন স্বীকার করবে না, যখন চামড়া ছিলে ছিলে লবন, লেবুর রস লাগাবো তখন স্বীকার করবে। অন্য একজন ভাঙ্গা স্ট্যাম্পগুলো তার মায়ের দিকে ছুড়ে মেরে বলে, লাকড়ি করার জন্য এগুলো রেখে গেলাম।
আমি ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হই। কী অসভ্যতা! কী বর্বরতা! তুহিনের মামা সাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ছবি দেখায়। তুহিনের শরীরের চামড়া কেটে সত্যিই লবন-লেবুর রস লাগানো হয়েছিল। তুহিনকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর রাতভর তার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন । নির্মম নির্যাতনের ফলে সে রাতেই তুহিন শাহাদাত বরণ করে। মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর র‌্যাব তার লাশ সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
নির্যাতনের চিহ্ন
পরবর্তীতে র‌্যাব অজ্ঞাত ট্রাক চালককে আসামী করে মামলা করে। সেখানে তারা উল্লেখ করে, রাতে তুহিনকে নিয়ে যখন বের হয়, তখন সে পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফ দিলে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চয়ে চলে যায়। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ট্রাক চাপা দেয়ার তো কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং আপনাদের নির্যাতনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে । র‌্যাব তখন জানায়, উপর থেকে যেভাবে নির্দেশ দেয়া আছে, সেভাবেই বললাম। আমাদের এর বাইরে কিছ’ বলার নাই।
হায়রে র‌্যাব! হায়রে অজ্ঞাত ট্রাক চালক! হায়রে আমাদের স্বাধীনতা!
সেদিন সকাল বেলায় র‌্যাব স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা চলাকালীন সকাল ৯টায় স্কুল মাঠ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফুলকুড়ি স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র আল-আমিন ও রাফিকে। অপর দিকে হেফজুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসা হোষ্টেল থেকে দুপুর ২টায় গ্রেপ্তার করা হয় আলীম প্রথম বর্ষের ছাত্র মেহদি হাসানকে। আসাদুল্লাহ তুহিনকে নিয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। র‌্যাব ক্যাম্পে সবাইকে একাত্রে রাখা হয়েছিল। একে একে সবাইকে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকালে এক র‌্যাব সদস্য বলে, তোদের জীবন এখানে শেষ, যা সবাই অজু করে আয়। সবাই যেতে চাইছিল না, কিন্তু আসাদুল্লাহ তুহিন সাথে সাথে গিয়ে থেতলানো শরীর নিয়ে পাশ্বের পানি দিয়ে অজু করে নেয়।
এরপর সবার ওপর আবার নির্যাতন চলে। বিদ্যুত শক দেয়া হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত করে লবন-লেবুর রস লাগিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে সবাইকে র‌্যাব অফিসারের পা ধরে মাফ চাইতে বলে। বাকি সবাই মাফ চাইলেও তুহিন তখনও বলেছে, আমি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করতে পারবো না। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি কেন মাফ চাইবো?
তার দৃঢ়তা দেখে র‌্যাব সদস্যরা আবার নির্যাতন চালাতে থাকে। বাকী তিন জনকে পরদিন থানায় দিলেও তুহিনের লাশ দেয় হাসপাতালে। পরবর্তীতে নির্যাতনের শিকার অন্যরা এসব ঘটনা জানায়।
আমরা মনে হয় নিজের দেশেই পরাধীনতার জিঞ্জির পরে আছি। বর্বর সব ঘটনার কথা আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়। স্তম্ভিত হয়ে যাই। যারা এই ছেলেদের নির্যাতন করছে, তাদের কি বৌ-বাচ্চা, ভাই-বোন নেই? তাদের কি একটুও মায়া হয় না? হয় তারা বিবেকহীন, আর না হয় রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তারা অভিশপ্ত। আল্লাহ তাদের অন্তর থেকে মায়া উঠিয়ে নিয়েছেন।
কথা শেষ করে তুহিনকে যে রুম থেকে নিয়ে গিয়েছিল সেটি দেখে আমরা বের হই। মা’কে বললাম, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। যেন আমরা তুহিন যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করতো, আমরা যেন সে লক্ষ্যপানে পৌছতে পারি। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলছেন, বাবা তোমাদের জন্য দোয়া করি। সবার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন তোমাদেরকে জালিমের হাত থেকে হেফাজত করেন। তোমাদের ইচ্ছা যেন আল্লাহ পুরণ করেন।
##

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন