রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরবে কে?


                                                              মনির আহমেদ
কুমিল্লায় দুই গ্রুপে সংঘর্ষে নিহত শহর সভাপতি সাইফুলের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকার ছবি

ছাত্রলীগ, ছাত্রসমাজের কাছে এখন এক আতঙ্কের নাম। ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র হত্যার মহা উৎসবে মেতে উঠেছে এই সংগঠনটি। কে বিরোধী আর কে নিজ দলের বাছাই করার সময় এই দলের ক্যাডারদের হাতে নেই। সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা, অপরকে পিটিয়ে ছাতু বানানোই এদের কাজ। ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা এখন তাদের কাছে ডাল-ভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক নির্যাতনেও বেশ এগিয়ে। এদের অপকর্মের তালিকা করতে বসলে তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে।
আজকের লেখার এই শিরোনামটি তৈরি করে রেখেছিলাম চার মাস আগেই। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় সময় করতে না পারায় লেখা হয়ে উঠেনি। সাথে এই ভাবনাটিও অবশ্যই ছিল যে সত্য তুলে ধরতে গিয়ে কার চক্ষুশুল হতে হয়! কারা আবার কি মনে করে! আজ সিদ্ধান্ত নিয়েই লেখা শুরু করলাম।
ছাত্রলীগের এরা তো আমার দেশের সন্তান, আমাদেরই কারো ভাই, কারো আত্মীয়, কারো প্রতিবেশী। এরা হয়তো দেশের কল্যান ও ছাত্রসমাজের জন্য কিছু করার চিন্তা নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিল । দুঃখজনক হলেও সত্য, কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা আজ ছাত্রসমাজের অঘোষিত শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এসকল ছাত্রনেতাদেরই কেউ কেউ ব্যবহার করছে। সমাজে তৈরি করছে প্রতিহিংসার দাবানল, ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা। ক্ষমতার মুলা সামনে ঝুলিয়ে ছাত্র রাজনীতির নবীন ছেলে বা মেয়েটিকে করে তুলছে অন্ধ। কেউ সমাজে পরিচিতি লাভ করছে ক্যাডার, আবার কেউ সন্ত্রাসী, কেউ অমুক-তমুক ভাইয়ের ডান-বাম হাত হিসাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আসা ছাত্রটি যে লক্ষ্য নিয়ে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বরং সে হয়ে উঠছে প্রতিহিংসাপ্রবন। কাকে টেক্কা দিয়ে কীভাবে ওপরে ওঠা যায়, এটাই চিন্তায় থাকে। সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নিজেই শুধু ক্ষমতাধর হবে, অন্য কেউ যেন না হয়। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েই নেতৃত্বের একটা জায়গায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের প্রত্যাশা নিয়েই শুরু হয়ে যায় অপরের সাথে দ্বন্দ।
গত ১১এপ্রিল কুমিল্লায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সেক্রেটারী সিদ্দিকী নাজমুল আলম গিয়েছিলেন কর্মী সভা করার জন্য। মূলত সেখানে কাউন্সিল মিটিং কমিটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সভাপতি-সেক্রেটারীর উপস্থিতিতেই সেখানে সংঘর্ষ শুরু হয়। নেতারা কমিটি গঠন সম্পূর্ণ না করেই ফিরে আসেন। পর দিন মারা যায় সাইফুল নামের একজন। গুলির পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে সাইফুলকে ছুরি দিয়ে আহত করে তাদেরই অপর পক্ষ। সাইফুলের নিথর দেহ এমনভাবে রাস্তায় পড়ে ছিল তা যে কোন বিবেকবান মানুষেরই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে বাধ্য।
ঠিক যেভাবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জামায়াত-শিবিরের মুজাহিদ, মাসুম, জসিমদের লাশ পড়েছিল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশী কষ্ট অনুভব করেছি কারন সাইফুল আমর খুব পরিচিত ছিল। সাইফুল স্থানীয় এমপি বাহারের গ্রুপ করে, যারা মেরেছে সুমন দাসের নেতৃত্বে, তারা রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের গ্রুপ করে।
একই ভাবে ১৬এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় হল দখলকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ও রংপুরের কিশোরগঞ্জ গ্রামের মিল্টন এবং বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও দিনাজপুর সদর উপজেলার বড় গুড়গোলা এলাকার জাকারিয়া নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জন। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থা ছয়জনের।
দিনাজপুরের এই ঘটনাও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণেই হয়েছে।  সেখানে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক অরুণের সমর্থকদের সাথে ছাত্রলীগের রজ্জবের সমর্থকরা শেখ রাসেল হলের দখল নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
 এর আগে গত বছরের ২০ নভেম্বর শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শাবিপ্রবিতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে নিহত হন সিলেট সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন। ২২ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় শিরোনাম হয়- “ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ, ৬ বছরে নিহত ৩৯”। সেখানে বলা হয়েছে এই হিসাব ২০০৯সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২১ নভেনম্বর ২০১৪ পর্যন্ত। সেখানে আরো তুলে ধরা হয়েছে এ সকল কর্মকা-ের কারণে ছাত্রলীগ ১৬৩ জনকে বহিষ্কার করেছে। যদিও এ সকল বহিষ্কার শুধুই লোক দেখানো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ফিল্মি কায়দায় ভারী অস্ত্র হাতে ছাত্রদের উপর আক্রমনের ঘটনা ঘটিয়ে বহিস্কার হয়েছিল যে তুহিন, সেই তুহিনই আবার পরে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারী হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অস্ত্রের প্রশিক্ষণের কথা মনে হয় সবারই কম বেশী জানা আছে। এর আগে আরো কত হত্যাকান্ড যে ঘটেছে এর কোন ইয়ত্তা নেই।
ছাত্রী নির্যাতনের কথা বলতে গেলে আসলে নিজেদেরকেই লজ্জিত হতে হয়। সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিকের সেঞ্চুরির ঘটনা সকলেরই মনে থাকার। আজো অবাক হই, মানিক সেঞ্চুরি করে মিষ্টি বিতরণ করে উৎসব পালন করেছিল! তখন মন্ত্রী পর্যায়ের একজন নাকি তার পিঠে চাপড়িয়ে বলেছিলেন, দুষ্ট ছেলে এসব করতে নেই! বাহ!
এই পয়লা বৈশাখে যা দেখালো তারা! টিএসসি, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ যতগুলো ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সবকটিতেই ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা জড়িত। এ সকল গঠনায় নিজ দলের ৮ জনকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। পর্দার অন্তরালে যে আরো কত কী ঘটছে!
ছাত্র-ছাত্রীদের নির্যাতনের পাশাপাশি শিক্ষকরাও বাদ যাচ্ছে না ছাত্রলীগের হাত থেকে। গত ১২ এপ্রিল ফেইজবুকের একটি কমেন্টের সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে লঞ্চিত করে ছাত্রলীগ। তার সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা শুধু ছাত্রলীগ নয় পুরো ছাত্রসমাজকে লজ্জিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বানে বিচারের দাবিতে সেখানে একাডেমিক কর্মবিরতি চলছে। অন্যদিকে আবার ছাত্রলীগই সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফেইজবুকের কমেন্টের বিচার চেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। শিক্ষক নির্যাতন করে আবার মামলা দায়ের!
গত নভেম্বর ২০১৪ হাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে বহিষ্কার করার পরে কয়েকজন শিক্ষকদের শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে শিক্ষকরা আবার বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নামেন। 
গত কিছু দিন আগে প্রশ্ন ফাঁস ছিল সকলের মুখেমুখে। এ ক্ষেত্রেও ছাত্রলীগই প্রধান ভূমিকায়, তা পত্রপাত্রিকার মাধ্যমে দেশের মানুষ জানতে পেরেছে।
এছাড়া অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা ঘটনা বারবারই ঘটিয়ে আলোচনায় এসেছে, আসছে ছাত্রলীগ।
হায়রে ছাত্ররাজনীতি! হায়রে ছাত্রলীগ! হায়রে মনুষত্ববোধ!
প্রশ্ন হলো, শুধু কি ছাত্রলীগই দায়ী? নাকি ছাত্রলীগের পাশাপাশি যারা তাদেরকে আজ বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করছে তারাও দায়ী? ছাত্ররাজনীতি তো হবে ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতার জন্য, কল্যানের জন্য, ভবিষ্যত সৎ যোগ্য আদর্শ নেতৃত্ব তৈরির জন্য। এখনই যদি ছাত্র নেতারা প্রতিহিংসা, লুটপাট, দখলদারী, অনৈতিকতার সাথে জড়িয়ে যায়, তাহলে জাতি তাদের কাছ থেকে কি পাবে?
বর্তমানে ছাত্রলীগের যে অবস্থা, তাতে এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা অস্বাভাবিক হবেনা। কিন্তু আওয়ামী সরকার ছাত্রলীগকে বড় আদরেই রেখেছে। এই সন্ত্রাসী সংগঠটির লাগাম টেনে ধরা আজ সময়ের দাবি। কিন্তু কে ধরবে? কারা সেই সাহসী?
লেখক: সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন