সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভারতের পানি আগ্রাসন: এ বন্ধুত্বের শেষ কোথায়?

'পানির অপর নাম জীবন'। পানি মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহের অন্যতম। পানি ব্যতীত মানুষ একদিনও চলতে পারেনা । খাবার পানি যেমন মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে, তেমনি প্রাকৃতিক নদীর পানি মানুষের ফসল উৎপাদনে সহযোগীতা করে যা মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে সহযোগী হয়। একই ভাবে অতিরিক্ত পানির কারণে মানুষের ক্ষতি হয়। পানিতে পড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, বন্যায় মানুষের সর্বস্ব হারাতে হয় । কৃষিজাত দ্রব্য ও উৎপাদিত ফসলের ক্ষতি হয়। এটাই পৃথিবীর বাস্তবতা। এ বাস্তবতা নিয়েই মানুষের চলতে হয়।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ । যার তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। এ দেশের তিন দিকে ভারত এবং এক দিকে বঙ্গোপসাগর। বন্ধু নির্বাচনে প্রত্যেকেই নিকটের এবং কৃতজ্ঞদেরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সে আলোকে বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু দেশ ভারত।

ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে সহযোগীর ভূমিকা রাখলেও স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আসলে সে দিকে আর ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন মনে করেন না তারা। যার একটি দিক পানি, ফারাক্কা বাঁধ।

ভারত গ্রীষ্মকালে ইচ্ছেমতো পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় পদ্মা অববাহিকায় গোটা বাংলাদেশ পরিণত হয় মরুভূমিতে। অন্যদিকে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার কারণে প্লাবিত হয় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল।

১৯৬১ সালে পদ্মা (ভারতীয় অংশে গঙ্গা হিসেবে পরিচিত) নদীর ওপর এ বাঁধ নির্মাণ শুরু করে ভারত। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত এই বাঁধের কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে।

বাংলাদেশের কথা চিন্তা না করে শুষ্ক মৌসুমে কলকাতা বন্দর সচল রাখতে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ ফিডার খালের মাধ্যমে পদ্মার অধিকাংশ পানি হুগলি নদীর অভিমুখে চালিত করে।

১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ২,২৪০ মিটার লম্বা ফারাক্কার বাঁধ চালু হয়। চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন।

এর পর থেকে আজ পর্যন্তও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ফারাক্কা এক মহাঅভিশাপে রুপ নিয়েছে। প্রয়োজনে পানি পায় না বাংলাদেশ। কিন্তু যখন বন্যার প্রাদুর্ভাব ঘটে অর্থাৎ, পানি যখন অভিশাপ হিসেবে নদীপাড়ের মানুষের কাছে আবির্ভূত হয়, তখন ভারতও এ বাঁধ খুলে দেয়। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটে।

এবারও এমন ঘটনা ঘটালো ভারত। ভারতের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সে দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় গঙ্গার ওপর নির্মিত বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধের সবকটি গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে দিয়ে পানি ছেড়ে দিলে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তাদের মতে, বর্ষাকালে এমনিতেই অন্য সময়ের তুলনায় ফারাক্কায় বেশি গেট খোলা থাকে।

ফারাক্কার গেট সংখ্যা ১০৪টি। এর মধ্যে ১০০টি গেট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে যাবে, যাতে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইতোমধ্যে অন্তত ৯৫টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কুষ্টিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

যার প্রভাবে ইতিমধ্যে জেলার দৌলতপুর উপজেলা চিলমারি ও রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রতিটি ঘরেই পানি ঢুকে পড়েছে। ঘরের মধ্যে মজুদ রাখা পাট, ধান মরিচসহ সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এসব এলাকায় তীব্র খাবার পানি সংকট দেখা দিয়েছে।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদীতে পানির বিপদসীমা হচ্ছে ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। সেখানে শুক্রবার দুপুর ১২ টায় পানি প্রবাহিত হয় ১৪ দশমিক ০৬ সেন্টিমিটার। বিপদসীমা থেকে মাত্র পয়েন্ট ১৯ সেন্টিমিটার দূরে।

গত ১৮ আগস্ট এ পানির মাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার। ১৯ আগস্ট ছিল ১৩ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। ২৫ আগস্ট ছিল ১৩ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার। প্রতি তিন ঘন্টায় ২ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রধান শাখা গড়াই নদেও অব্যাহতভাবে পানি বাড়ছে।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নেয়ামূল হক জানান, বিহারে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া ভারত তাদের ফারাক্কা বাঁধের দরজা খুলে দিয়েছে। তাতে পদ্মায় পানি বেড়ে যাচ্ছে। যে গতিতে পানি বাড়ছে তাতে যে কোন সময় পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে।

দৌলতদিয়া উপজেলার চিলমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমেদ জানান, গত কয়েক দিন ধরে অব্যাহতভাবে পদ্মা নদীর পানি বাড়ায় চিলমারির ১৮ গ্রামের ৪০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ। তিনি দাবি করেন সাম্প্রতিক সময়ে বন্যায় এতো ক্ষতি আর কখনও হয়নি।

রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন জানান, রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের চরাঞ্চলের ১২ গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এখানকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এলাকায় তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা ছিল। যাতে করে পদ্মায় অন্তত পানি প্রবাহ থাকতো। খরার দুর্যোগে আক্রান্ত হতো না বাংলাদেশ।

কিন্তু তার বদলে অসময়ে বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত দুই দেশের সীমান্তের দুই পাশের নদীকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীকে বিপদে ফেলছে। কারণ, ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের সীমান্তবর্তী মানুষদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে আসলে ভারত বাংলাদেশের সাথে কতটুকু বন্ধুসুলভ আচরণ করছে? সময় এসেছে ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে চুড়ান্ত কথা বলার, ফারাক্কা বাঁধ আদৌ থাকবে কীনা, থাকলেও তা কিভাবে থাকবে? এই বিতর্কিত বাঁধ একেবারেই তুলে দেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এটাই উপযুক্ত সময়। দুই দেশের বন্ধুত্ব সর্বকালের রেডর্ক অতিক্রম করছে। বন্ধুত্বের জোয়ারে প্রায় বিনামূল্যে ট্রানজিট প্রদান, বন্দর ব্যবহারের অবাধ সুযোগ ও সুন্দরবনের কাছে রামপালে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প স্থাপনের অনুমতি থেকে শুরু করে ভারতকে শুধু দিয়েই যাচ্ছে সরকার। বিনিময়ে তিস্তা চুক্তিটি পর্যন্ত হয়নি, ফারাক্কা ইস্যুতে হয়নি কোন সুরাহা। একতরফা বন্ধুত্বের ভার আর কতকাল বহন করবে লাখ শহীদের রক্তেভেজা এই স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে আর কত গোলামীর মতো আচরণ সহ্য করতে হবে দেশবাসীকে?


প্রকাশিত: www.timenewsbd.com/news/detail/88253