বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০১৫

আমাদের স্বাধীনতা পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত নয়


আমরা স্বাধীন। এই কথা হৃদয়ে ধারণ করি, গর্ব অনুভব করি। কিন্তু তবুও একটা কষ্ট। মনে প্রশ্ন আসে- আমরা কি সত্যিই স্বাধীন। স্বাধীন বাংলাদেশ গান গেয়েও তো দেখি এই জনপদের অনেক মানুষ মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারছে না। বলতে হয়, আমরা স্বাধীন। কিন্তু পরাধীনতা এখনো বারবার আমাদের স্বাধীনতায় ছোবল মারে।

সেদিন খুলনা যাচ্ছিলাম। কাওয়াকান্দি থেকে মাইক্রো সার্ভিসে উঠলাম। ছোট একটা গাড়ি। নয়টা সিট, কিন্তু আমরা বসলাম ১৮ জন। কিছুই করার নাই, যেতে হবে। সুতরাং তারা যেভাবে নেয় সেভাবেই যেতে হচ্ছে। কোন প্রশ্ন করা মানে বিপাকে পড়া। করলেই সোজা জানিয়ে দেবে, ‘আপনি যাবেন? গেলে যান না হয় অন্য গাড়ীতে আসেন।‘ আসহায় মনে হয় নিজেকে!
এই শ্রেনীর মানুষদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি। একটু খোঁজার, তলিয়ে দেখার প্রয়াস পেলাম। দেখা গেল ১৮ জন থেকে ৫৫০০টাকা তারা ভাড়া নেয়। কিন্তু ড্রাইভারের হাতে দেয়া হয় ৩২০০ টাকা। বাকি টাকা? বিষয়টি সবার কাছেই দিনের আলোর ন্যায়মত স্পষ্ট। এমপি সাহেবের ভাগ, পরিচালনা কমিটি, এলাকার বড় ভাই সবাইকে এখান থেকে একটা অংশ দিতে হবে। একই ভাবে গত ঈদের আগের দিন স্পিড বোটে করে যাচ্ছিলাম। সব সময় ভাড়া নেয় ১৫০, সেদিন নিল ২৫০ টাকা। বোটের চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ১০০ টাকা যে বেশী সেটা কি তোমরা পাবে? তার উত্তর, ‘না ভাই আমরা যা পেতাম তাই পাব। বাকিটা মন্ত্রী, এমপি, ঘাটের খরচ।‘
বলছিলাম খুলনা যাওয়ার সময়ের কথা। মাইক্রোতে বেশী লোক বসায় এক জনের পায়ের সাথে অন্য জনের পা লাগছিল। সবাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিচ্ছিল। শুরু হল কথা। একজন সিরিয়ার কথা তুললেন। বললেন, ‘সেখানে মানুষদের জীবন যাপন নিয়ে। বাশার আল আসাদ অনেক দিন থেকে সে দেশের প্রেসিডেন্ট। মানুষের স্বাধীনতা বলতে গেলে নাই-ই। জোর যার মুল্লুক তার। এভাবেই চলছে তাদের সব কিছু, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যা বরাদ্দ তা দিয়েই চলতে হয়। এমনকি পানি পর্যন্ত সরকারের নিকট থেকে বরাদ্দ।‘
আমি জানতে চাইলাম, ভাই তারা টিউবওয়েল বসায় না কেন? লোকটির উত্তর, ‘মাটি খোঁড়াও নিষিদ্ধ! টিউবওয়েল বসানোর তো প্রশ্নই আসেনা।‘
‘পুরুষ মানুষের বয়স ১৮ এর বেশী হলে অধিকাংশকে হত্যা করা হয়, কারণ তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে। এজন্য সেখানে পুরুষরা যারা বেঁচে থাকে তারা কোন কাজ করে না। বাইরে বের হলে গুলির মুখে পড়তে হতে পারে, তাই ক্ষেত-খামারের কাজ থেকে শুরু করে সব কাজ মহিলারাই করে। আইন-আদালত বলতে গেলে নাই। যাকে ভাল লাগছেনা গুলি করে হত্যা করছে। দেশ কয়েক  ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষ সরকার, এক পক্ষ সেনাবাহিনী, এক পক্ষ বিরোধী দল। যে যার মত করে চলছে। কাউকে ভাল না লাগলে গুলি করে হত্যা করছে। সখানে সবার কাছে অ¯্র থাকা বৈধ। সুতরাং কোন ঘটনা ঘটলে অস্ত্র নিয়েই সবাই বের হয়। কোন বিচার ব্যবস্থা সেভাবে নেই।‘
যার কাছ থেকে শুনছিলাম তিনি মিশনে গিয়েছেন কয়েকবার। সিরিয়ায় তার বেশ কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছে। সিরিয়ার এ অবস্থার কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় আমরা বেশ স্বাধীন আছি। এখনো আমাদের পুরুষরা বের হয়ে কাজ করতে যেতে পারে। হয়তো বিরোধী দল ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং করতে পারছেনা। কিন্তু তাতে কি! আমরা তো বাজারে যাই, কাজ করি। হয়তো সংবাদপত্র সম্পাদক, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার চেয়ারম্যানদের ডেকে সরকারের পক্ষে থাকার জন্য হয়তো হুমকি দেয়া হচ্ছে, হয়তো সঠিক কথা না বলতে সুশীল সমাজকে নিষেধ করা হচ্ছে, হয়তো গ্রহনযোগ্য নির্বাচন না হলেও ক্ষমতা ছেড়ে পুনরায় নির্বাচন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে, হয়তো পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির কর্তা ব্যাক্তিদের পছন্দ মত নিয়োগ দিয়ে বিরোধী দল দমনে সরকার তাদের ওয়াদা করিয়ে নিচ্ছে, হয়তো রাষ্ট্রীয় বাহিনী কাউকে হত্যা, কাউকে গুম, কাউকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীন করছে; কিন্তু তারপরও আমরা যে এখনো টিউবওয়েল বসিয়ে পানি তুলে খেতে পারছি! রাস্তায় ভয় নিয়ে হলেও চলতে পারছি। সেটাই বা কম কীসে?
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে স্বাধীন শব্দের অর্থ দেয়া আছে- ১.বাধাহীন; আজাদ; মুক্ত; স্বচ্ছন্দ(স্বাধীন গতি) ২.নিজের বশে; অনন্যনির্ভর (স্বাধীন মতামত) ৩.সার্বভৌম; বিদেশী দ্বারা শসিত নয় এমন।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে “স্বাধীন - স্বাধীনতা” শব্দের অর্থের কোন মিল আছে বলে আমার মনে হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন এই পরিস্থিতি? আমরা কেন পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিনা? ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের চেয়ে কেন অন্য রাষ্টের নেতৃত্বকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে? কেনইবা অবৈধ নির্বাচনের বৈধতার সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজের দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সুযোগ করে দিতে হবে? এসব বিষয় সন্দেহাতীতভাবে আলোচনার দাবি রাখে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলামানরা বড় একটা সময় পৃথিবী শাসন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ মুসলিম শাসক ছিলেন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা। সেই ১৭৫৭ সালের কথা। লর্ড ক্লাইভদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা পাওয়ার জন্য মুসলিম শাসকদের ভেতরে থাকা বৃটিশদের চর ঘসেটি বেগম, মীরজাফররা সেদিন বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরাজিত হয়ে ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল মুসলিম শাসন আমল। কিন্তু মুসলমানরা অপ্রতিরুদ্ধ জাতি, পরাজয় তারা কখনো মেনে নিতে পারে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে তারা সব সময় এগিয়ে গিয়েছে। যদিও প্রায় দুইশত বছর আমাদেরকে ইংরেজদের কাছে পরাধীন থাকতে হয়েছে। কিন্তু অব্যাহত প্রতিরোধ ও বিরোধীতায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে এক সময় তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এর আগেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী  দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন। তখন মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে তারা শুধুমাত্র হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়নি। গড়ে ওঠে হিন্দু জনপদ নিয়ে হিন্দুস্থান ভারত। আর মুসলমান জনপদ নিয়ে মুসলমানদের কল্যাণ রাষ্ট্র পাকিস্তান । কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমরা যারা পূর্ব পাকিস্থানের অধিবাসী ছিলাম, স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে থেকেও অনেকটা পরাধীনের মতই ছিলাম। শারমিন আহমেদ ‘নেতা ও পিতা‘ বইয়ে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য ২২মার্চ ১৯৭১ আওয়ামীলীগ নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ লিখে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন আপনি স্বাক্ষর করে দিন। তিনি তখন বলেছিলেন তুমি কি আমাকে দেশদ্রোহী বানাতে চাও? এখানে স্বাক্ষর করা মানে তারা আমাকে রাষ্ট্র দ্রোহী মামলা দিয়ে জেলে নিবে। হতাশ হয়ে তাজ উদ্দিন ফিরে এলেন।’
২৫ মার্চ কালো রাতে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন এবং বাংলার মানুষের উপর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা শুরু হয়। ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যুদ্ধ শূরু হয়।
১৭ এপ্রিল অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের কাঠামো গঠিত হয়ে পূর্নাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী, ভারতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী এবং কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধ করে। সেটি ভিন্ন আলোচনা।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলার পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকাল ৪.৩১ মিনিটে জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী বাহিনী ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার কাছে আত্মসমর্পন করে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু তখনই ভারতের কাছে যে আমাদের পরাধীন থাকতে হবে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক’দিন আগেও ভারত মওকা মওকা ভিডিও তৈরি করেছে। সেখানে তারা বুঝাতে চেয়েছে তারা বাংলাদেশকে আমাদের দান করেছে! যুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনী প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ন সব সম্পদ নিয়ে যায়। আমাদের দেশকে পরিণত করে তলাবিহীন ঝুড়িতে। আমাদের দেশ পরিণত হয় তাদের বাজারে।
আমাদের দেশীয় প্রতিনিধির হাতে শাসন ক্ষমতা এলেও মূলত ইংরেজ শাসন আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার নামে আমাদের গোলামী ও পরাধীনতার হাত বদল হয়েছে মাত্র! বর্তমানে আমরা স্বাধীন হয়েও আধিপত্যবাদী ভারতের ছোবলের শিকার হচ্ছি।
পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন যেমন গৌরবের, তেমনি ভারতের আধিপত্যবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়াও অনেকটা লজ্জার। যা বর্তমান প্রজন্ম এখন কিছুটা বুঝতে শুরু করেছে। 
এই আধিপত্যবাদের হাত থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের প্রয়োজন গনতন্ত্রের সঠিক চর্চা। প্রয়োজন বিরোধী মতের যথাযথ মূল্যায়ন। প্রয়োজন সাহসী পদক্ষেপের, সৎ দক্ষ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বে। প্রয়োজন জনগণের অংশগ্রহনমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক


ছাত্ররাজনীতিঃ লেজুড়বৃত্তিতে বাড়ছে অবক্ষয় -২য় পর্ব




গত ডিসেম্বর২০১৪ সংখ্যায় যেখানে শেষ করেছিলাম দুটি লাইন উল্লেখ করেই আজকের অংশটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
‘একজন সচেতন মানুষ কখনোই একটি টেপ রেকর্ডারের মত নয়। একটি টেপ রেকর্ডার যে কোন কিছু ধারণ করে হুবহু তা তুলে ধরে। সচেতন যে কোন মন কোনকিছু শোনার পর তা যাচাই করে নেয়। নিজের বিবেচনা বোধকে কাজে লাগিয়ে কোন কাজে যুক্ত হয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সাথে আজ যারা যুক্ত, তাদের মাঝে এ বিবেচনা বোধ আছে কি?’
ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব আমাদেরই। আর এজন্য আমাদের এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

ছাত্র রাজনীতি কেন প্রয়োজন?
যদিও নিকট অতীতে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন অনেকেই, কিন্তু প্রায় শতভাগ মানুষই এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নেন। ছাত্র রাজনীতি যেমন ছাত্র সমাজের জন্য প্রয়োজন, তেমনিভাবে দেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ চিন্তাকে সামনে রাখলেও এ রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা পরিস্কার হয়ে যায়।
ক.ছাত্রসমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন
আজ যারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসায় পড়ছে, তারা প্রতিনিয়তই নানা ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করে পথ চলছে। ছাত্র সমাজের যে কোন সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে ও তা সমাধানের লক্ষে পৌছানোর জন্যই ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন। ধরুন, একটি কলেজে কোন ধরণের রাজনীতি নেই। সেই কলেজে হাজারো সমস্যা রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই কলেজের এসব সমস্যাকে তুলে ধরে প্রতিকারের দাবি নিয়ে উচ্চবাচ্য করার মত তেমনভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। ছাত্রদের আবাসন, শিক্ষার পরিবেশ, সামর্থের আলোকে বেতনাদি নির্ধারণ, এসব বিষয় নিয়ে ছাত্রদেরই তো সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে। আর সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বিষয়টিই ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনকে স্পষ্ট করে।

খ.শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা
অবক্ষয়ের ফলে আজ ছাত্র রাজনীতি যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে অনেকেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার পেছনে এই রাজনীতিকেই দেখতে পান। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়াই কি এর সমাধান। নাকি ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানো? মূলত, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যই ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন। রাজনীতি হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিরা সামনের সারিতে চলে আসেন। তারাই সমাজ ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমনি। যোগ্য ছাত্ররা নেতৃত্বে আসে ও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সচেষ্ট থাকে। ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফলে আজ অনেক ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীকে সামনের সারিতে দেখতে পাই। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, যোগ্য ছাত্র কোন শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বে থাকলে সে অনেক ছাত্রকে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিতে পারে। ছাত্রদের মেধার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসসহ নানা সমস্যার থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করে।  
গ.গনতন্ত্র চর্চার শিক্ষা ক্ষেত্র
গণতন্ত্র এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। এই পদ্ধতি শুধু রাষ্ট্রের জন্যই যে প্রয়োজন, তা নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ, রাষ্ট্রের ভেতরের নানা পর্যায়ে এর চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি একজন ছাত্রকে গণতন্ত্র মনস্ক করে তোলে। গণতন্ত্রের পথ ধরে কীভাবে চলতে হয়, তা-ই শিক্ষা দেয়। আজ যখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির পর্যালোচনা হয়, তখন বোদ্ধারা ঠিকই বলেন, রাজনীতির পথ বেয়ে উঠে আসা নেতা জাতীয় রাজনীতিতে কমে যাচ্ছে। ফলে অবক্ষয় বাড়ছে। যে ছেলেটি ছাত্র রাজনীতি করেছে, পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে, সে স্বাভাবিকভাবেই তার দেশ ও দেশের সমস্যা-সম্ভাবনাকে ভালোভাবে অনুধাবন করবে। কিন্তু এ ধরণের মানুষের অভাবের কথাই বোদ্ধারা বলে থাকেন। আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, গণতন্ত্রের প্রথম ধাপের সবকটি দেয় ছাত্র রাজনীতি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে তা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আরো শক্তিশালী করবে।
ঘ.সমসাময়িক সংকটে ভূমিকা পালন
রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িতরাই। এটাকে খারাপ হিসেবে দেখার কোন কারণ নেই। দেশে যে কোন সংকট তৈরি হলে ছাত্র রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা হয়তো টেবিল আলোচনায় সমাধানের পথ দেখান না, কিন্তু যে কোন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রাজপথে তারা সংগ্রাম করেন। অতীতে ছাত্র রাজনীতি কীভাবে সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছে, ইতোপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে। দেশের চলমান সংকটেও ছাত্র রাজনীতি বড় ভূমিকা রাখছে। অপশাসন বিরোধী সংগ্রামে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ছাত্রজনতা রাজপথে সংগ্রাম চালিয়েই যাচ্ছে।
ঙ.আগামী নেতৃত্ব তৈরি
এই প্রয়োজনটি সকলেই ভালোভাবে অনুধাবন করেন। ছাত্র রাজনীতি করার মাধ্যমেই একজন ছাত্র নেতৃত্ব কী, জনগণের প্রত্যাশা কী, কীভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণে ভূমিকা রাখতে হয়, তা শিখতে পারেন। এসব শেখার মধ্য দিয়েই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্রটির মাঝে জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। কোন ব্যক্তি হঠাৎ করেই নেতা হয়ে যান না। কিংবা কেউ নেতা হয়েই জন্ম নেন না। নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবার আগে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়। ছাত্র রাজনীতি একজন ছাত্রকে তার গুনাবলি বিকশিত করার মাধ্যমে আগামী দিনের কারিগর হিসেবে তৈরি করে। কাজেই, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে দেশে ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত থাকা জরুরী।

কারা ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়

দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন জনমনে একটা ধারণা জন্মেছে যে ভালো ছেলেরা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় না। বাস্তবতা হলো, ছাত্র রাজনীতি কলুষযুক্ত হওয়ায় ভালো অনেকে চাইলেও কলুষমুক্ত থাকতে পারছে না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত- সব ধরণের পরিবার থেকেই একটা সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী রাজনীতিতে যুক্ত হন। একেক ধরণের অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে এসে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের চিন্তা ও কাজে পার্থক্য থাকে। একটু আলোকপাতের চেষ্টা করছি।
উচ্চবিত্ত: স্বাভাবিক ভাবে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব বেশী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় না। যারা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তারা পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রয়োজনে রাজনীতি করে। আর একটি অংশ করে শখের বশে। যেহেতু উচ্চবিত্ত হওয়ায় সম্পদের কোন অভাব নেই, তাই অর্থব্যয়ের একটা মাধ্যম হিসেবেও অনেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ছাত্র রাজনীতিতে এলে অবশ্য কম সময়ে নেতৃত্বে চলে আসারও সুযোগ পায়।
 মধ্যবিত্ত: মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই আর দশজনের মাঝে একটু মর্যাদার আসনে থাকার স্বপ্ন দেখে। একইভাবে স্বপ্ন দেখে অর্থশালী হওয়ার। আর এ কারণেই অনেকে রাজনীতিকে পাখির চোখ করে। দেখা যায়, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই রাজনীতিতে বেশী সক্রিয়। নিজেকে চূড়ান্ত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা যে কোন বড় ভাইয়ের হাত ধরে শুরু করে। বড় ভাইয়ের সকল চাহিদা পূরণেও তারা সচেষ্ট থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই কোনটা নৈতিক কোনটা অনৈতিক সেটা বিবেচনায় নেয় না। কলুষযুক্ত ছাত্র নেতারা এর সুযোগ নেন। নতুন রাজনীতিতে আসা ছেলেমেয়েদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মেও এই ছেলেমেয়েদের ব্যবহার করা হয়। কমিটি গঠনকে সামনে রেখে কাউকে পোস্ট দেয়ার মুলো ঝুলিয়ে নানান অপকর্ম করিয়ে নেয়া হয়। এক সময়ে মধ্যবিত্ত ঘরের কেউ কেউ নেতা হবার সুযোগও পেয়ে যায়, কিন্তু তাদের নৈতিকতা বোধ ততদিনে চুলোয় ওঠে। দুঃখ হলো, যে নেতৃত্বের বেড়ে ওঠাই এভাবে, সেই নেতৃত্ব থেকে দেশ-জাতি খুব বেশী কী-ইবা  আশা করতে পারে?
ঠেকায় পড়ে রাজনীতি: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে উঠতে হলে মোটামুটি কোন না কোন বড় ভাইয়ের হাত ধরেই উঠতে হয়। আর কেউ যদি নিজে নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলে উঠে, তাহলে তাকে প্রথম অথবা দ্বিতীয় রাতেই র‌্যাগের শিকার হতে হয়। এই র‌্যাগ সম্পর্কে আপনাদের সবার জানা আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এক নতুন ছাত্রকে র‌্যাগ দেয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হলে নতুন ওঠা এক ছেলেকে প্রথম রাতেই ৬/৭জন বড় ভাই তাদের রুমে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল করতে থাকে। ছেলেটিকে মদ পান করিয়ে এবনরমাল করে ফেলে। পরে তার সাথে সবাই একের পর এক জোর করে সমকামিতায় লিপ্ত হয়। ছেলেটি বুঝতে পারেনা কী করবে। সকাল বেলায় তার অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখে হল কতৃপক্ষ। ছেলেটি বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলে তার আর পড়ালেখা হয়ে উঠেনি। এ রকম বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে বড় ভাইদের গ্রুফের সদস্য হতে হয়। কাউকে আবার নির্যাতন না করে ধমক দিয়েই গ্রুফের মেম্বার করে নেয়। শুরু  হয় বড় ভাইদের কথা অনুযায়ী  নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া। এক পর্যায়ে কেউ কেউ ভাল ভাবেই শুরু করে, কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আবার কেউ নেতৃত্বে চলে যায়।
মূলত লেজুড়বৃত্তির কারণেই ছাত্রদের মাঝে আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে যায়। নিজেকে সবাই তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর তুলে ধরতে গিয়েই আতংক ছড়ানোর প্রয়োজন হয়। এটা অবশ্যই অস্ত্র ব্যতিত হয় না। অস্ত্রের ব্যবহার এখন রাজনীতির জন্য অনেকটা ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছে। গত নভেম্বর মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি স্বীকার করে নিয়েছেন যে তারা অস্ত্র ব্যবহার করেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, আগের থেকে অস্ত্রের পরিমান কমানো হয়েছে। এর দ¦ারা বুঝা যায় পূর্বে আরো বেশী অস্ত্রের ব্যবহার ছিল। আর বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার, বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রকাশ এবং নিজেদের স্বীকারোক্তির পরও প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তার করে না কারণ এ সকল ছাত্রনেতাদের তারা সরকারের অংশ মনে করে। ছাত্রনেতাদের কথায় অনেক সময় তাদের চাকরী, বদলি, প্রমোশন সুপারিশ এগুলো নির্ভর করে, সুতরাং ইচ্ছা করেই এমপি-মন্ত্রীর রোষানলে পড়ার কী দরকার? যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের অস্ত্র ব্যবহার জায়েজ হয়ে যায়।
এছাড়া আদর্শিক কারনেও অনেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে ।
                                                                                                         ...................  চলবে








                

প্রথম পর্বের লিংকঃ  http://monirahmedbd.blogspot.com/2014/12/blog-post.html

http://chhatrasangbadbd.com/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A7%9C%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4/

বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫

একজন শামীমের বাবা ও জনগণের অধিকার : মনির আহমেদ


শামীম (ছদ্মনাম), বয়স তখন সাত-আট বছর। গ্রামের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে প্রতিদিন সকালে মক্তবে যেত সে। মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে। একদিনের ঘটনা। সেদিনও সে মক্তবে গিয়েছিল। কিন্তু মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে যেতে পারলো না। পাড়ার সব ছেলে-মেয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলেও তার যাওয়ার উপায় নেই। কারণ তার বাবা অসুস্থ্য।
শামীম বুঝতে পারে তার বাবার অবস্থা বেশ খারাপ। ছোট্ট সে শুধু কাঁদতে থাকে।
বাবার কী হয়েছে? অনেক চিন্তা শামীমের মাথায় জটলা পাকায়। এ সময় চাচা-জ্যাঠাদের গর্জন শুনতে পায় সে। তারা বলাবলি করছে, আমাদের ডাকলিনা কেন? ‘কত বড় সাহস আমাদের বাড়ির সামনে এসে আমাদের ভাইকে এভাবে মেরে যাবে? এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
শামীম বুঝতে পারে কেউ তার বাবাকে মেরে আহত করেছে। খানিক পরেই সে মূল ঘটনা বুঝতে পারে।
শামীমদের বাড়ির পাশে ১২ শতকের একটি ভিটা আছে। তাদের গ্রামে বাড়ির পাশের উঁচু জমিকে ভিটা বলে। কিছু দিন থেকে এই ভিটা নিয়ে প্রায় সময় বাড়িতে তার বাবা বাসায় আম্মার সাথে কথা বলে। চাচা-জেঠাদের সাথেও বেশ ক’বার কথা বলেছে। এই ভিটা নিয়েই গ-গোল।
শামীমের দাদা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিল। বিভিন্ন সময় জমি বিক্রি করেছে মানুষের কাছে। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছে অথবা কাউকে এমনিতেই দলিল করে দিয়েছে। তার দাদা মানুষ হিসেবে অনেক উদার ছিল। সাধারন মানুষের কষ্ট একেবারেই সহ্য করতে পারত না। তাই সে মানুষের জন্য সাধ্যমত করতো। আর এই সুযোগ কিছু সুবিধাভোগী মানুষ কাজে লাগায়। কেউ হয়তো ১০ শতক নিয়েছে, কিন্তু ১৫ শতক ব্যবহার করা শুরু করতো। দাদার সরলতার সুযোগে এ কাজটি অনেকেই করেছে। পরবর্তীতে তার ছেলে মেয়েরা যখন বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে, তাদেরও সন্তানাদি হয়েছে; তখন জমির গুরুত্ব তাদের কাছে স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
শামীমের বাবা ইতিমধ্যে বের করেছে যে ভিটাটি তাদের। তখন তার বাবা ভিটার মালিক ও গ্রামের মুরুব্বিদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে। মালিক পক্ষও ভিটা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় এবং বলে যে, ঠিক আছে আপনারা দখল নেন।
ঘটনার দিন সকাল বেলা শামীমের বাবা জমিটি দখলে নেয়। হাল চাষও শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে একজন ঝামেলা পাকায়। সে এতদিন যে ভিটাটি ভোগ করেছে, তাকে গিয়ে কুবুদ্ধি দেয়। সে বলে, কেন শামীমের বাবা এতদিন পরে ভিটাটি দখল করবে? শামীমের বাবাকে ভিটা দখলে নেয়া থেকে বিরত রাখতে সে পরামর্শ দেয়।
 কুবুদ্ধি ধরেই এতদিনের অবৈধ ভোগকারী লোকবল নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। শামীমের বাবা যখন ভিটায় হাল চাষ করতে যায়, তখন তার ওপর হামলে পড়ে। ফলে শামীমের বাবা গুরুতর আহত হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । 
ঘটনাটি এখানেই থেমে থাকে না। শামীমের বাবার বিরুদ্ধে সেদিনই মামলা করা হয়। দুপুর নাগাদ শামীমদের বাড়ীতে পুলিশ আসে। মামলাকারী প্রভাবশালী। তার বাপ-দাদারা দরিদ্র ছিল, কিন্তু সে নানাভাবে অর্থশালী হয়ে উঠেছে। কাজেই পুলিশ এসেছে। পুলিশের উপস্থিতি শামীমদের গ্রামে স্বাভাবিক নয়। পুলিশের খবর পেয়ে গ্রামের অনেক মানুষেরা জটলা পাকায়। সবার মাঝে এক ধরণের আতঙ্ক। পুলিশেরা শামীমের বাবার নাম করে গালাগালি করতে থাকে, জানান দেয় যে কাকে খুঁজতে এসেছে। শামীম হঠাৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বসে, আমার বাবাকে তোমাদের কী দরকার? শুনেই এক পুলিশ বন্দুকের নল দিয়ে শামীমের মাথায় মারে।
মুহুর্তেই গ্রামের মানুষেরা ভয়ে শামীমদের বাড়ি থেকে চলে যায়। এই অবস্থা শুনে হাসপাতাল থেকে শামীমের অসুস্থ্য বাবাই বাড়ীতে চলে আসে। বাড়ির লোককে শান্ত থাকতে বলে।
পরবর্তীতে শামীমের বাবাকেও বাড়ির লোকেরা মামলা করার পরামর্শ দেয়। ফলে মামলা দায়ের হয়। শুরু হয় মামলা পাল্টা মামলার খেলা। এই ভাবে চলে তিন বছর।
পরে মামলার রায় শামীমের বাবার পক্ষেই আসে। বিরোধী পক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করায় রায় স্থগিতও হয়।তারা যখন বুঝতে পারে যে মামলা চালিয়ে তাদের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন তাদের পক্ষ থেকে শামীমের বাবার কাছে প্রস্তাব আসে, তারা আর মামলা চালাতে চায় না। গ্রামেই বিষয়টি সমাধান করতে চায়। শামীমের বাবা তা মেনে নেয়। গ্রামে সালিশ বসে। শামীমের বাবা ভিটা পান। পাশাপাশি মামলার পুরো খরচ। তাকে অসম্মান ও এতদিন অন্যায় ভাবে জমিন ভোগ করার জন্য জরিমানা স্বরুপ ভিটা ভোগকারী চার শতক অতিরিক্ত জমিন রেজিষ্ট্রি করে দেয়।
এবারে আসি দেশের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচনও হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। কিন্তু জনগণ বারবার তত্ত্বাবধায়কের পক্ষেই দাবি তোলে। কিন্তু আওয়ামীলীগ জনগণ বা কোন রাজনৈতিক দলের কথায় কর্ণপাত করে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই ভোটার বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, ৫% এর বেশি ভোটার উপস্থিত ছিল না। যদিও সরকার হিসাব দিয়েছে ৪০% ভোটের। অনেকে সংলাপের বিষয়ে তখন বললেও আওয়ামীলীগের বক্তব্য ছিল- আগে নির্বাচন হয়ে যাক, এরপর সংলাপ করে আবার নির্বাচন দেয়া যাবে। 
পরবর্তীতে বিরোধী দল ও জনগণ দেখলো আসলে আওয়মীলীগ ভোটের আগে সংলাপের বিষয়ে বললেও সরকার গঠনের পর তারা এই বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি নয়। অগত্যা দাবি আদায়ে এলো বিক্ষোভ সমাবেশ, হরতাল কর্মসূচী। এসবের পরও আওয়ামী সরকার কর্ণপাত করলো না। এবারে মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অবৈধ সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শন্তিপূর্ণ সমাবেশের আহ্বান করা হলো। এই সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের জন্য চুড়ান্ত আন্দোলন ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু সরকার সমাবেশ হতে না দেয়ায় দেশে তীব্র সঙ্কট দেখা দিল। অবরুদ্ধ হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। লাগাতার অবরোধ চলতে থাকলো। দফায় দফায় হরতালও।
সরকার শুরু করলো গ্রপ্তার, নির্যাতন, ক্রসফায়ার। একদিকে হরতাল-অবরোধে দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা, অন্যদিকে সরকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার।
কারা মরছে? সাধারণ মানুষ। এই পর্যন্ত চলমান সঙ্কটে প্রায় শতাধিক মানুষের জীবন দিতে হলো। হাজারো গ্রেপ্তার, গুরুতর আহত শতাধিক মানুষ। বর্তমানে রাস্তায় মানুষ প্রতিবাদ করতে পারছেনা। রাস্তায় নামলেই পুলিশের গুলি। সরকারের কর্তাব্যক্তি আর প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের কথায় কোন তফাৎই নেই।  সবাই একই সুরে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলছে।
প্রতিদিনই কোন না কোন মানুষের গাড়ি আগুনে জ্বলছে, কেউ না কেউ সন্তান, স্বামী হারাচ্ছে, ব্যবসা-বানিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপিদের কেউ বলছেন দেশে কোন অস্থিরতা নেই, আবার কেউ বলছেন দেশে অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ন সমাধানের। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা, তখন প্রতিবাদ জানাতে গুলশানে এসেছেন গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেন নূর। তার কাছে কোন লাঠি, অস্ত্র বা নাশকতা চালানোর মত কিছু ছিল না। তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। প্রতিদিনই কোন না কোন সরকার সমর্থক গোষ্ঠি মানব বন্ধন, মিছিল অথবা খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করতে আসছে। এসবে কোন সমস্যাও নেই। অন্যদিকে নূর হোসেন একা প্রতিবাদ জানাতে এসেছে, এটাই সমস্যা! মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে শক্ত ভূমিকা পালনকারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মতিঝিলে অনশন করছেন অবরোধ তুলে নেয়া এবং সংলাপ-সমঝোতার জন্য, তিনিও একদিন নামায পড়ে এসে দেখেন তার বিছানাপত্র নেই। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, বিছানা-পত্র গুলো না নিলে কি হতো না? পরবর্তিতে কোন এক অশুভ ইশারায় তার কোন খবর এখন পত্রিকার পাতায় বা অন্যান্য গণমাধ্যমে দেখা যায় না।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন প্রতিবাদ করলে গ্রেপ্তার আর পুলিশের গুলি, ঠিক তখনই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের অধিবাসী জালাল উদ্দিন মজু (যিনি নিজেকে দার্শনিক ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেয়ারম্যান হিসাবে দাবি করেছেন)  গাছে উঠে অভিনব পন্থায় ২৪ ঘন্টার প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি দাবি করেন মাটিতে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে দেশের জনগণ। তাই তিনি ক্রসফায়ার, পেট্রোল বোমা, হরতাল, অবরোধের মত ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই কর্মসূচি পালন করেন। সকল পত্রিকায়, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তার খবর প্রচার করে। সরকারেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। গ্রেফতার করা হয় তাকেও। যেখানে তার কর্মসূচি শান্তির পক্ষে- কোন নাশকতা নেই, ভাংচুর নেই, জনগনের জান-মালের কোন ক্ষতি নেই; সেখানে কার স্বার্থে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো?
সরকার প্রধান কি ধরে নিয়েছেন হিটলার ,কর্নেল গাদ্দাফি ও সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও তিনি শক্তিধর?
যদি ধরে নিয়ে থাকেন তাহলে তাদের পরিণিতির কথা কি একবার ভেবে দেখা দরকার নয়?
আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সেই কুবুদ্ধিদাতা যেমন শামীমের বাবার প্রতিপক্ষকে মামলায় নামিয়ে দিয়েছিল, এখনও সরকারের আশে-পাশে থাকা বাম ঘরনার ইনু-মেননরা কুপরামর্শ দিয়ে সমাধানের পথ থেকে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে রেখেছে। একই ভাবে এটাও মনে হয়, শামীমের বাবাকে সম্মানহানি করার দায়ে প্রতিপক্ষকে যেমন জরিমানা দিতে হয়েছিল, তেমন জরিমানা এই সরকারকেও দিতে হবে। তবে আশংকা হলো, এখন যারা সমাধানের কথা বলছেন, আসলে তখন তারা এবং জনগণ (যাদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে) শুধু জরিমানায় রাজি হবেন কিনা?

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক