শামীম (ছদ্মনাম), বয়স তখন সাত-আট বছর। গ্রামের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে প্রতিদিন সকালে মক্তবে যেত সে। মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে। একদিনের ঘটনা। সেদিনও সে মক্তবে গিয়েছিল। কিন্তু মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে যেতে পারলো না। পাড়ার সব ছেলে-মেয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলেও তার যাওয়ার উপায় নেই। কারণ তার বাবা অসুস্থ্য।
শামীম বুঝতে পারে তার বাবার অবস্থা বেশ খারাপ। ছোট্ট সে শুধু কাঁদতে থাকে।
বাবার কী হয়েছে? অনেক চিন্তা শামীমের মাথায় জটলা পাকায়। এ সময় চাচা-জ্যাঠাদের গর্জন শুনতে পায় সে। তারা বলাবলি করছে, আমাদের ডাকলিনা কেন? ‘কত বড় সাহস আমাদের বাড়ির সামনে এসে আমাদের ভাইকে এভাবে মেরে যাবে? এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
শামীম বুঝতে পারে কেউ তার বাবাকে মেরে আহত করেছে। খানিক পরেই সে মূল ঘটনা বুঝতে পারে।
শামীমদের বাড়ির পাশে ১২ শতকের একটি ভিটা আছে। তাদের গ্রামে বাড়ির পাশের উঁচু জমিকে ভিটা বলে। কিছু দিন থেকে এই ভিটা নিয়ে প্রায় সময় বাড়িতে তার বাবা বাসায় আম্মার সাথে কথা বলে। চাচা-জেঠাদের সাথেও বেশ ক’বার কথা বলেছে। এই ভিটা নিয়েই গ-গোল।
শামীমের দাদা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিল। বিভিন্ন সময় জমি বিক্রি করেছে মানুষের কাছে। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছে অথবা কাউকে এমনিতেই দলিল করে দিয়েছে। তার দাদা মানুষ হিসেবে অনেক উদার ছিল। সাধারন মানুষের কষ্ট একেবারেই সহ্য করতে পারত না। তাই সে মানুষের জন্য সাধ্যমত করতো। আর এই সুযোগ কিছু সুবিধাভোগী মানুষ কাজে লাগায়। কেউ হয়তো ১০ শতক নিয়েছে, কিন্তু ১৫ শতক ব্যবহার করা শুরু করতো। দাদার সরলতার সুযোগে এ কাজটি অনেকেই করেছে। পরবর্তীতে তার ছেলে মেয়েরা যখন বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে, তাদেরও সন্তানাদি হয়েছে; তখন জমির গুরুত্ব তাদের কাছে স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
শামীমের বাবা ইতিমধ্যে বের করেছে যে ভিটাটি তাদের। তখন তার বাবা ভিটার মালিক ও গ্রামের মুরুব্বিদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে। মালিক পক্ষও ভিটা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় এবং বলে যে, ঠিক আছে আপনারা দখল নেন।
ঘটনার দিন সকাল বেলা শামীমের বাবা জমিটি দখলে নেয়। হাল চাষও শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে একজন ঝামেলা পাকায়। সে এতদিন যে ভিটাটি ভোগ করেছে, তাকে গিয়ে কুবুদ্ধি দেয়। সে বলে, কেন শামীমের বাবা এতদিন পরে ভিটাটি দখল করবে? শামীমের বাবাকে ভিটা দখলে নেয়া থেকে বিরত রাখতে সে পরামর্শ দেয়।
কুবুদ্ধি ধরেই এতদিনের অবৈধ ভোগকারী লোকবল নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। শামীমের বাবা যখন ভিটায় হাল চাষ করতে যায়, তখন তার ওপর হামলে পড়ে। ফলে শামীমের বাবা গুরুতর আহত হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ।
ঘটনাটি এখানেই থেমে থাকে না। শামীমের বাবার বিরুদ্ধে সেদিনই মামলা করা হয়। দুপুর নাগাদ শামীমদের বাড়ীতে পুলিশ আসে। মামলাকারী প্রভাবশালী। তার বাপ-দাদারা দরিদ্র ছিল, কিন্তু সে নানাভাবে অর্থশালী হয়ে উঠেছে। কাজেই পুলিশ এসেছে। পুলিশের উপস্থিতি শামীমদের গ্রামে স্বাভাবিক নয়। পুলিশের খবর পেয়ে গ্রামের অনেক মানুষেরা জটলা পাকায়। সবার মাঝে এক ধরণের আতঙ্ক। পুলিশেরা শামীমের বাবার নাম করে গালাগালি করতে থাকে, জানান দেয় যে কাকে খুঁজতে এসেছে। শামীম হঠাৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বসে, আমার বাবাকে তোমাদের কী দরকার? শুনেই এক পুলিশ বন্দুকের নল দিয়ে শামীমের মাথায় মারে।
মুহুর্তেই গ্রামের মানুষেরা ভয়ে শামীমদের বাড়ি থেকে চলে যায়। এই অবস্থা শুনে হাসপাতাল থেকে শামীমের অসুস্থ্য বাবাই বাড়ীতে চলে আসে। বাড়ির লোককে শান্ত থাকতে বলে।
পরবর্তীতে শামীমের বাবাকেও বাড়ির লোকেরা মামলা করার পরামর্শ দেয়। ফলে মামলা দায়ের হয়। শুরু হয় মামলা পাল্টা মামলার খেলা। এই ভাবে চলে তিন বছর।
পরে মামলার রায় শামীমের বাবার পক্ষেই আসে। বিরোধী পক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করায় রায় স্থগিতও হয়।তারা যখন বুঝতে পারে যে মামলা চালিয়ে তাদের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন তাদের পক্ষ থেকে শামীমের বাবার কাছে প্রস্তাব আসে, তারা আর মামলা চালাতে চায় না। গ্রামেই বিষয়টি সমাধান করতে চায়। শামীমের বাবা তা মেনে নেয়। গ্রামে সালিশ বসে। শামীমের বাবা ভিটা পান। পাশাপাশি মামলার পুরো খরচ। তাকে অসম্মান ও এতদিন অন্যায় ভাবে জমিন ভোগ করার জন্য জরিমানা স্বরুপ ভিটা ভোগকারী চার শতক অতিরিক্ত জমিন রেজিষ্ট্রি করে দেয়।
এবারে আসি দেশের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচনও হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। কিন্তু জনগণ বারবার তত্ত্বাবধায়কের পক্ষেই দাবি তোলে। কিন্তু আওয়ামীলীগ জনগণ বা কোন রাজনৈতিক দলের কথায় কর্ণপাত করে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই ভোটার বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, ৫% এর বেশি ভোটার উপস্থিত ছিল না। যদিও সরকার হিসাব দিয়েছে ৪০% ভোটের। অনেকে সংলাপের বিষয়ে তখন বললেও আওয়ামীলীগের বক্তব্য ছিল- আগে নির্বাচন হয়ে যাক, এরপর সংলাপ করে আবার নির্বাচন দেয়া যাবে।
পরবর্তীতে বিরোধী দল ও জনগণ দেখলো আসলে আওয়মীলীগ ভোটের আগে সংলাপের বিষয়ে বললেও সরকার গঠনের পর তারা এই বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি নয়। অগত্যা দাবি আদায়ে এলো বিক্ষোভ সমাবেশ, হরতাল কর্মসূচী। এসবের পরও আওয়ামী সরকার কর্ণপাত করলো না। এবারে মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অবৈধ সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শন্তিপূর্ণ সমাবেশের আহ্বান করা হলো। এই সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের জন্য চুড়ান্ত আন্দোলন ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু সরকার সমাবেশ হতে না দেয়ায় দেশে তীব্র সঙ্কট দেখা দিল। অবরুদ্ধ হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। লাগাতার অবরোধ চলতে থাকলো। দফায় দফায় হরতালও।
সরকার শুরু করলো গ্রপ্তার, নির্যাতন, ক্রসফায়ার। একদিকে হরতাল-অবরোধে দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা, অন্যদিকে সরকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার।
কারা মরছে? সাধারণ মানুষ। এই পর্যন্ত চলমান সঙ্কটে প্রায় শতাধিক মানুষের জীবন দিতে হলো। হাজারো গ্রেপ্তার, গুরুতর আহত শতাধিক মানুষ। বর্তমানে রাস্তায় মানুষ প্রতিবাদ করতে পারছেনা। রাস্তায় নামলেই পুলিশের গুলি। সরকারের কর্তাব্যক্তি আর প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের কথায় কোন তফাৎই নেই। সবাই একই সুরে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলছে।
প্রতিদিনই কোন না কোন মানুষের গাড়ি আগুনে জ্বলছে, কেউ না কেউ সন্তান, স্বামী হারাচ্ছে, ব্যবসা-বানিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপিদের কেউ বলছেন দেশে কোন অস্থিরতা নেই, আবার কেউ বলছেন দেশে অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ন সমাধানের। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা, তখন প্রতিবাদ জানাতে গুলশানে এসেছেন গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেন নূর। তার কাছে কোন লাঠি, অস্ত্র বা নাশকতা চালানোর মত কিছু ছিল না। তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। প্রতিদিনই কোন না কোন সরকার সমর্থক গোষ্ঠি মানব বন্ধন, মিছিল অথবা খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করতে আসছে। এসবে কোন সমস্যাও নেই। অন্যদিকে নূর হোসেন একা প্রতিবাদ জানাতে এসেছে, এটাই সমস্যা! মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে শক্ত ভূমিকা পালনকারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মতিঝিলে অনশন করছেন অবরোধ তুলে নেয়া এবং সংলাপ-সমঝোতার জন্য, তিনিও একদিন নামায পড়ে এসে দেখেন তার বিছানাপত্র নেই। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, বিছানা-পত্র গুলো না নিলে কি হতো না? পরবর্তিতে কোন এক অশুভ ইশারায় তার কোন খবর এখন পত্রিকার পাতায় বা অন্যান্য গণমাধ্যমে দেখা যায় না।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন প্রতিবাদ করলে গ্রেপ্তার আর পুলিশের গুলি, ঠিক তখনই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের অধিবাসী জালাল উদ্দিন মজু (যিনি নিজেকে দার্শনিক ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেয়ারম্যান হিসাবে দাবি করেছেন) গাছে উঠে অভিনব পন্থায় ২৪ ঘন্টার প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি দাবি করেন মাটিতে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে দেশের জনগণ। তাই তিনি ক্রসফায়ার, পেট্রোল বোমা, হরতাল, অবরোধের মত ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই কর্মসূচি পালন করেন। সকল পত্রিকায়, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তার খবর প্রচার করে। সরকারেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। গ্রেফতার করা হয় তাকেও। যেখানে তার কর্মসূচি শান্তির পক্ষে- কোন নাশকতা নেই, ভাংচুর নেই, জনগনের জান-মালের কোন ক্ষতি নেই; সেখানে কার স্বার্থে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো?
সরকার প্রধান কি ধরে নিয়েছেন হিটলার ,কর্নেল গাদ্দাফি ও সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও তিনি শক্তিধর?
যদি ধরে নিয়ে থাকেন তাহলে তাদের পরিণিতির কথা কি একবার ভেবে দেখা দরকার নয়?
আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সেই কুবুদ্ধিদাতা যেমন শামীমের বাবার প্রতিপক্ষকে মামলায় নামিয়ে দিয়েছিল, এখনও সরকারের আশে-পাশে থাকা বাম ঘরনার ইনু-মেননরা কুপরামর্শ দিয়ে সমাধানের পথ থেকে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে রেখেছে। একই ভাবে এটাও মনে হয়, শামীমের বাবাকে সম্মানহানি করার দায়ে প্রতিপক্ষকে যেমন জরিমানা দিতে হয়েছিল, তেমন জরিমানা এই সরকারকেও দিতে হবে। তবে আশংকা হলো, এখন যারা সমাধানের কথা বলছেন, আসলে তখন তারা এবং জনগণ (যাদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে) শুধু জরিমানায় রাজি হবেন কিনা?
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন