মনির আহমেদ
১৭৫৭ সালের ২৩জুন বৃটিশদের কাছে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার যে পরাজয় ঘটেছিল, তা উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য ছিল বড় আঘাত। হাজার বছর উপমহাদেশের শাসন কার্যক্রম পরিচালনার পর হঠাৎ বৃটিশ বাহীনির দখলের আঘাত সামলে নতুন করে নিজেদেরকে গুছিয়ে তুলতে যে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন ছিল। সেই অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসাবে মুসলমানরা প্রথম যাকে পান তিনিই শহীদ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী।
সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর বড় হয়ে ওঠার পথে মুসলিম সমাজে অবক্ষয় লক্ষ্য করেন। তিনি একদিকে যেমন ব্রিটিশ রাজত্বে মুসলমানদের পরাজিত হতে দেখেন, অন্যদিকে মুসলিম সমাজে ঢুকে যাওয়া অনেক কুসংস্কারও প্রত্যক্ষ করেন। ফলে তিনি যেভাবে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, একইভাবে মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কারের বিজ উপড়ে ফেলতেও ছিলেন তৎপর। ‘তরিকায়ে মুহাম্মদী’ নামে যে বিপ্লবী আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন, তা ছিল সকল কুসংস্কার বাদ দিয়ে শুদ্ধভাবে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসরণ করার লক্ষেই। তিনি আন্দোলন শুরু করে প্রথমে পেশওয়ার নিজের নিয়ন্ত্রনে নেন এবং সেখান থেকেই বৃটিশদের কাছ থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলন পরিচালনা করা শুরু করেন। বিপ্লবী এই আন্দোলন নিয়ে ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর স্বপ্ন।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক, সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী (র.)- ছিলেন উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলন ও ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠায় এক নির্ভীক সিপাহসালার। তিনি জীবনের মূল্যবান সময়কে দীন ইসলামের জন্য কুরবানী করে গেছেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট বিশেষত ইসলামী আন্দোলন কর্মীদের নিকট মে মাসটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস। ১৮৩১ সালের এই দিনে বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী শাহাদাত বরণ করেছিলেন। মুসলমানরা সেদিন শিখদের কাছে পরাজয় বরণ করেছিল। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদের শিক্ষা, বাতিলকে মোকাবেলা করে কী করে সাহস নিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়; তা যুগের পর যুগ ধরে প্রেরণার সুউচ্চ মিনার হয়ে রয়েছে। আজো আমরা ফিরে তাকাই বালাকোটের দিকে। চারদিকের আঁধার ভেদ করে আলোর রেখা জ্বালবার সাহস পাই হৃদয়ে।
বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভীর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াটাই ছিল সাহসের পরিচায়ক। ব্রিটিশ রাজ বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায়, ভারতীয় মুসলমানরা এ যুদ্ধের মাধ্যমেই তা বুঝতে পারেন। ফলে সময়ের ব্যবধানে আমরা আরো অনেক প্রচেষ্টা দেখতে পাই। একের পর এক প্রচেষ্টার ফলেই একটা সময়ে ব্রিটিশরা হাল ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
বালাকোট যুদ্ধ পলাশীর কয়েক দশক পরের কথা। মূলত এ যুদ্ধ সাইয়েদ আহমাদের পরিকল্পনায় ছিল না।মূলত তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রনে থাকা পেশওয়ার নিয়ে বৃটিশদের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে কাশ্মীরের দিকে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল কাশ্মীরে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে দখল মুক্ত করবেন। সাইয়েদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যেই জনগণের ওপর শিখদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের খবর পান। এই খবর পেয়ে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এ সময়ই শিখদের বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্য চান বিভিন্ন এলাকার প্রধানেরা। ফলে তিনি কাশ্মীর সফর স্থগিত করে এ অবস্থার একটা বিহিত করার পথকেই বেছে নেন। ফলে যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠে।
শিখ সেনাপতি রণজিৎ সিংয়ের ছেলে বালাকোটে আক্রমন করতে পারে, এমন খবর পেয়েই সাইয়েদ আহমদ ভুগাড়মুঙ্গ থেকে বালাকোটে ফেরেন। বালাকোটের জন্য তিনি চমৎকার যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
বালাকোটে ৭০০ মুজাহিদের বিপরীতে ১০ হাজার শিখ সৈন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারপরও মুসলমানরা যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেয়। ৩০০ মুজাহিদের শাহাদাত বরণের উল্টো পিঠে শিখ সৈন্য মারা যায় ৭০০ জন। মুসলমানদের সংখ্যয় কম থাকার পাশাপাশি সে যুদ্ধে রসদও কম ছিল। সাইয়েদ আহমাদ অনেকটা ওহুদ যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বালাকোটের কয়েকটি প্রবেশ পথে সাইয়েদ আহমাদ মুজাহিদদের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত করেন। এসব প্রবেশ পথ বাদ দিয়ে বালাকোটে ঢোকা ছিল অসম্ভব। শিখরা অনেক ক্ষতি শিকার করেই সংখ্যাধিক্যের প্রাবল্য নিয়েই একটা সময় বালাকোটে প্রবেশ করে। বলা হতো, বালাকোটের মেটিকোট পাহাড় যার, সেই যুদ্ধে জয়ী হবে। ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই এমন কথা প্রচলিত ছিল।
শিখরা ১৮৩১ সালের ৫ মে মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করে। পরদিনই চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। ইসলামী শাসন কায়েমের বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে হয়তো সাইয়েদ আহমাদ সে সময় যুদ্ধ না করেই কাশ্মীরের পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সাইয়েদ আহমাদ পরাজয়ের প্রবল শঙ্কা মেনে নিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
যুদ্ধের দিন ছিল জুময়া বার। সেদিন সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর সহযোগী শাহ ইসমাইলকে নিয়ে সামনের সারিতেই ছিলেন। মেটিকোটের টিলা ছেয়ে ছিল শিখ সৈন্যদের দ্বারা। যুদ্ধে যে শিখ সেনারা নীচে নেমে আসছিল তাদের অধিকাংশই মুজাহিদদের হাতে নিহত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যা অনেক থাকায় শিখ সেনারা চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকে।
একটা পর্যায়ে মেটিকোটের ঝরণার মাঝে শাহাদাত বরণ করেন সাইয়েদ আহমাদ। শহীদ হন শাহ ইসমাইলও। সাইয়েদ আহমাদের মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত পাওয়াই যায়নি। তাঁর শাহাদাতের খবর না জানা থাকায় তাঁকে খুঁজতে গিয়ে আরো অনেকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। মৃতদেহ না পাওয়া যাওয়ায় যুদ্ধের পরও অনেক মুসলমান তাঁর শাহাদাত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
ঐ দিন তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদেরই প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
একই ভাবে নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫মে মতিঝিলের শাপলা চত্তরে একত্রিত হয়েছিলেন হেফাজত ইসলামের ব্যানারে বাংলার লাখো লাখো জনতা । দিন শেষে তারা নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে মতিঝিলে অবস্থান করার ঘোষনা দেন। রাত তখন ২টা কেউ ঘুমিয়ে, আবার কেউ এবাদতে রত, ঠিক এই সময়ে ৬তারিখ ভোর হওয়ার পূর্বেই সাধারন মুসলমানদের উপর আওয়ামী সরকারী বাহীনির চরম নির্মমতা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মৃত্যু কূপে পরিনত হয় মতিঝিলের শাপলা চত্তর । সাধারন জনতার আত্মচিৎকারে রাজধানী ঢাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে । বাচাঁর জন্য কোন আকুতিই সেদিন সরকারী বাহীনির হৃদয় নরম করতে পারেনি,হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর পরিনত হয়েছিল গুলিবিদ্ধ মুসল্লিদের বিছানায়। সেখানেও তারা থাকতে পারেননি। অনেকে শহীদ হয়েছেন,কেউ আহত হয়েছেন,কাউকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে,আবার কাউকে চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ী যেতে হয়েছে । সারাদেশের সাধারন মানুষরা শুধু ধিক্কার জানানো ব্যতিত কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি । দাবী আদায়ারে অনেক আন্দোলন আমরা দেখেছি, স্বদেশে আন্দোলন দমনের অনেক কৌশলও দেখেছি,কিন্তু সেদিন যা ঘটেছিল অতিতের কোন ঘটনার সাথে মিলানো সম্ভব হবেনা কারোই। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ নির্মমতা কারো কাম্য হতে পারেনা ।
ইসলাম এবং মুসলমানদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা আসলে যে ন্যক্কারজনক প্রতারণাপূর্ণ কৌশল নিয়েছিলেন সে বিষয়টাও পরিষ্কার হয়েছে। দেখা গেছে, মুখে না বললেও সর্বান্তঃকরণে তারা ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষই নিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা অভিমুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার নজির বিহীন ঘোষনা। বাস-ট্রাক থেকে লঞ্চ-স্টিমার শুধু নয়, ট্রেন এবং বিভিন্ন ঘাটে নৌযান চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী সরকার। ১৯৭১ সালে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, এবার লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রতিপক্ষ হয়েছে সরকার নিজেই। আর সরকারের নগ্ন রুপ প্রকাশ পেয়েছে ৬ মে ২০১৩ এর মধ্যরাতে! এর পূর্বে হেফাজতের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার পর কথিত শাহবাগি আন্দোলনের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ঘোষণা দেন, ‘শাহবাগ শান্ত হবে হেফাজতে ইসলামের রক্ত দিয়ে।’
সত্যি সত্যিই এই শাহবাগীরা রাষ্ট্রিয় শক্তির উন্মাদনায় হেফাজতের নিরস্ত্র লাখো জনতার রক্তের হোলি খেলা দেখে তারা এখন শান্ত কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষদেয় রক্তস্নাত কোন আন্দোলনই বৃথা যায়না। ক্ষরিত রক্ত থেকেই আন্দোলনের বীজ অংকুরিত হয়।
যেভাবে বালাকোটের রক্ত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশদের বিতাড়নে পারম্ভিক আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল,রফিক সালাম জব্বার বরকতদের রক্ত যেভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়নের পারম্ভিকা হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, একই ভাবে ধর্মপ্রান মুসলমানদের রক্তও ধর্মবিদ্বেশীদের বাংলার জমিন থেকে চিরতরে বিদায়ের সুতিকাগার হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে।
লেখকঃ সাংবাদিক
সধযসবফপাপ@মসধরষ.পড়স
বালাকোট প্রান্তর |
সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর বড় হয়ে ওঠার পথে মুসলিম সমাজে অবক্ষয় লক্ষ্য করেন। তিনি একদিকে যেমন ব্রিটিশ রাজত্বে মুসলমানদের পরাজিত হতে দেখেন, অন্যদিকে মুসলিম সমাজে ঢুকে যাওয়া অনেক কুসংস্কারও প্রত্যক্ষ করেন। ফলে তিনি যেভাবে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, একইভাবে মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কারের বিজ উপড়ে ফেলতেও ছিলেন তৎপর। ‘তরিকায়ে মুহাম্মদী’ নামে যে বিপ্লবী আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন, তা ছিল সকল কুসংস্কার বাদ দিয়ে শুদ্ধভাবে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসরণ করার লক্ষেই। তিনি আন্দোলন শুরু করে প্রথমে পেশওয়ার নিজের নিয়ন্ত্রনে নেন এবং সেখান থেকেই বৃটিশদের কাছ থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলন পরিচালনা করা শুরু করেন। বিপ্লবী এই আন্দোলন নিয়ে ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর স্বপ্ন।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক, সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী (র.)- ছিলেন উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলন ও ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠায় এক নির্ভীক সিপাহসালার। তিনি জীবনের মূল্যবান সময়কে দীন ইসলামের জন্য কুরবানী করে গেছেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট বিশেষত ইসলামী আন্দোলন কর্মীদের নিকট মে মাসটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস। ১৮৩১ সালের এই দিনে বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী শাহাদাত বরণ করেছিলেন। মুসলমানরা সেদিন শিখদের কাছে পরাজয় বরণ করেছিল। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদের শিক্ষা, বাতিলকে মোকাবেলা করে কী করে সাহস নিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়; তা যুগের পর যুগ ধরে প্রেরণার সুউচ্চ মিনার হয়ে রয়েছে। আজো আমরা ফিরে তাকাই বালাকোটের দিকে। চারদিকের আঁধার ভেদ করে আলোর রেখা জ্বালবার সাহস পাই হৃদয়ে।
বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভীর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াটাই ছিল সাহসের পরিচায়ক। ব্রিটিশ রাজ বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায়, ভারতীয় মুসলমানরা এ যুদ্ধের মাধ্যমেই তা বুঝতে পারেন। ফলে সময়ের ব্যবধানে আমরা আরো অনেক প্রচেষ্টা দেখতে পাই। একের পর এক প্রচেষ্টার ফলেই একটা সময়ে ব্রিটিশরা হাল ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
বালাকোট যুদ্ধ পলাশীর কয়েক দশক পরের কথা। মূলত এ যুদ্ধ সাইয়েদ আহমাদের পরিকল্পনায় ছিল না।মূলত তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রনে থাকা পেশওয়ার নিয়ে বৃটিশদের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে কাশ্মীরের দিকে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল কাশ্মীরে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে দখল মুক্ত করবেন। সাইয়েদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যেই জনগণের ওপর শিখদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের খবর পান। এই খবর পেয়ে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এ সময়ই শিখদের বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্য চান বিভিন্ন এলাকার প্রধানেরা। ফলে তিনি কাশ্মীর সফর স্থগিত করে এ অবস্থার একটা বিহিত করার পথকেই বেছে নেন। ফলে যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠে।
শিখ সেনাপতি রণজিৎ সিংয়ের ছেলে বালাকোটে আক্রমন করতে পারে, এমন খবর পেয়েই সাইয়েদ আহমদ ভুগাড়মুঙ্গ থেকে বালাকোটে ফেরেন। বালাকোটের জন্য তিনি চমৎকার যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
বালাকোটে ৭০০ মুজাহিদের বিপরীতে ১০ হাজার শিখ সৈন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারপরও মুসলমানরা যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেয়। ৩০০ মুজাহিদের শাহাদাত বরণের উল্টো পিঠে শিখ সৈন্য মারা যায় ৭০০ জন। মুসলমানদের সংখ্যয় কম থাকার পাশাপাশি সে যুদ্ধে রসদও কম ছিল। সাইয়েদ আহমাদ অনেকটা ওহুদ যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বালাকোটের কয়েকটি প্রবেশ পথে সাইয়েদ আহমাদ মুজাহিদদের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত করেন। এসব প্রবেশ পথ বাদ দিয়ে বালাকোটে ঢোকা ছিল অসম্ভব। শিখরা অনেক ক্ষতি শিকার করেই সংখ্যাধিক্যের প্রাবল্য নিয়েই একটা সময় বালাকোটে প্রবেশ করে। বলা হতো, বালাকোটের মেটিকোট পাহাড় যার, সেই যুদ্ধে জয়ী হবে। ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই এমন কথা প্রচলিত ছিল।
শিখরা ১৮৩১ সালের ৫ মে মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করে। পরদিনই চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। ইসলামী শাসন কায়েমের বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে হয়তো সাইয়েদ আহমাদ সে সময় যুদ্ধ না করেই কাশ্মীরের পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সাইয়েদ আহমাদ পরাজয়ের প্রবল শঙ্কা মেনে নিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
যুদ্ধের দিন ছিল জুময়া বার। সেদিন সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর সহযোগী শাহ ইসমাইলকে নিয়ে সামনের সারিতেই ছিলেন। মেটিকোটের টিলা ছেয়ে ছিল শিখ সৈন্যদের দ্বারা। যুদ্ধে যে শিখ সেনারা নীচে নেমে আসছিল তাদের অধিকাংশই মুজাহিদদের হাতে নিহত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যা অনেক থাকায় শিখ সেনারা চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকে।
একটা পর্যায়ে মেটিকোটের ঝরণার মাঝে শাহাদাত বরণ করেন সাইয়েদ আহমাদ। শহীদ হন শাহ ইসমাইলও। সাইয়েদ আহমাদের মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত পাওয়াই যায়নি। তাঁর শাহাদাতের খবর না জানা থাকায় তাঁকে খুঁজতে গিয়ে আরো অনেকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। মৃতদেহ না পাওয়া যাওয়ায় যুদ্ধের পরও অনেক মুসলমান তাঁর শাহাদাত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
ঐ দিন তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদেরই প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।
একই ভাবে নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫মে মতিঝিলের শাপলা চত্তরে একত্রিত হয়েছিলেন হেফাজত ইসলামের ব্যানারে বাংলার লাখো লাখো জনতা । দিন শেষে তারা নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে মতিঝিলে অবস্থান করার ঘোষনা দেন। রাত তখন ২টা কেউ ঘুমিয়ে, আবার কেউ এবাদতে রত, ঠিক এই সময়ে ৬তারিখ ভোর হওয়ার পূর্বেই সাধারন মুসলমানদের উপর আওয়ামী সরকারী বাহীনির চরম নির্মমতা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মৃত্যু কূপে পরিনত হয় মতিঝিলের শাপলা চত্তর । সাধারন জনতার আত্মচিৎকারে রাজধানী ঢাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে । বাচাঁর জন্য কোন আকুতিই সেদিন সরকারী বাহীনির হৃদয় নরম করতে পারেনি,হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর পরিনত হয়েছিল গুলিবিদ্ধ মুসল্লিদের বিছানায়। সেখানেও তারা থাকতে পারেননি। অনেকে শহীদ হয়েছেন,কেউ আহত হয়েছেন,কাউকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে,আবার কাউকে চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ী যেতে হয়েছে । সারাদেশের সাধারন মানুষরা শুধু ধিক্কার জানানো ব্যতিত কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি । দাবী আদায়ারে অনেক আন্দোলন আমরা দেখেছি, স্বদেশে আন্দোলন দমনের অনেক কৌশলও দেখেছি,কিন্তু সেদিন যা ঘটেছিল অতিতের কোন ঘটনার সাথে মিলানো সম্ভব হবেনা কারোই। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ নির্মমতা কারো কাম্য হতে পারেনা ।
ইসলাম এবং মুসলমানদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা আসলে যে ন্যক্কারজনক প্রতারণাপূর্ণ কৌশল নিয়েছিলেন সে বিষয়টাও পরিষ্কার হয়েছে। দেখা গেছে, মুখে না বললেও সর্বান্তঃকরণে তারা ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষই নিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা অভিমুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার নজির বিহীন ঘোষনা। বাস-ট্রাক থেকে লঞ্চ-স্টিমার শুধু নয়, ট্রেন এবং বিভিন্ন ঘাটে নৌযান চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী সরকার। ১৯৭১ সালে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, এবার লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রতিপক্ষ হয়েছে সরকার নিজেই। আর সরকারের নগ্ন রুপ প্রকাশ পেয়েছে ৬ মে ২০১৩ এর মধ্যরাতে! এর পূর্বে হেফাজতের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার পর কথিত শাহবাগি আন্দোলনের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ঘোষণা দেন, ‘শাহবাগ শান্ত হবে হেফাজতে ইসলামের রক্ত দিয়ে।’
সত্যি সত্যিই এই শাহবাগীরা রাষ্ট্রিয় শক্তির উন্মাদনায় হেফাজতের নিরস্ত্র লাখো জনতার রক্তের হোলি খেলা দেখে তারা এখন শান্ত কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষদেয় রক্তস্নাত কোন আন্দোলনই বৃথা যায়না। ক্ষরিত রক্ত থেকেই আন্দোলনের বীজ অংকুরিত হয়।
যেভাবে বালাকোটের রক্ত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশদের বিতাড়নে পারম্ভিক আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল,রফিক সালাম জব্বার বরকতদের রক্ত যেভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়নের পারম্ভিকা হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, একই ভাবে ধর্মপ্রান মুসলমানদের রক্তও ধর্মবিদ্বেশীদের বাংলার জমিন থেকে চিরতরে বিদায়ের সুতিকাগার হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে।
লেখকঃ সাংবাদিক
সধযসবফপাপ@মসধরষ.পড়স