মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০১৫

ঐতিহাসিক ৬মেঃ বালাকোট থেকে মতিঝিল

                                                                  মনির আহমেদ
বালাকোট প্রান্তর

১৭৫৭ সালের ২৩জুন বৃটিশদের কাছে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার যে পরাজয় ঘটেছিল, তা উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য ছিল বড় আঘাত। হাজার বছর উপমহাদেশের শাসন কার্যক্রম পরিচালনার পর হঠাৎ বৃটিশ বাহীনির দখলের আঘাত সামলে নতুন করে নিজেদেরকে গুছিয়ে তুলতে যে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন ছিল। সেই অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসাবে মুসলমানরা প্রথম যাকে পান তিনিই শহীদ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী।
সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর বড় হয়ে ওঠার পথে মুসলিম সমাজে অবক্ষয় লক্ষ্য করেন। তিনি একদিকে যেমন ব্রিটিশ রাজত্বে মুসলমানদের পরাজিত হতে দেখেন, অন্যদিকে মুসলিম সমাজে ঢুকে যাওয়া অনেক কুসংস্কারও প্রত্যক্ষ করেন। ফলে তিনি যেভাবে জিহাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, একইভাবে মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কারের বিজ উপড়ে ফেলতেও ছিলেন তৎপর। ‘তরিকায়ে মুহাম্মদী’ নামে যে বিপ্লবী আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন, তা ছিল সকল কুসংস্কার বাদ দিয়ে শুদ্ধভাবে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনুসরণ করার লক্ষেই। তিনি আন্দোলন শুরু করে প্রথমে পেশওয়ার নিজের নিয়ন্ত্রনে নেন এবং সেখান থেকেই বৃটিশদের কাছ থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলন পরিচালনা করা শুরু করেন।  বিপ্লবী এই আন্দোলন নিয়ে ভারতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর স্বপ্ন।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক, সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী (র.)- ছিলেন উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলন ও ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠায় এক নির্ভীক সিপাহসালার। তিনি জীবনের মূল্যবান সময়কে দীন ইসলামের জন্য কুরবানী করে গেছেন। উপমহাদেশের মুসলমানদের নিকট বিশেষত ইসলামী আন্দোলন কর্মীদের নিকট মে মাসটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট দিবস। ১৮৩১ সালের এই দিনে বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী শাহাদাত বরণ করেছিলেন। মুসলমানরা সেদিন শিখদের কাছে পরাজয় বরণ করেছিল। কিন্তু সাইয়েদ আহমাদের শিক্ষা, বাতিলকে মোকাবেলা করে কী করে সাহস নিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়; তা যুগের পর যুগ ধরে প্রেরণার সুউচ্চ মিনার হয়ে রয়েছে। আজো আমরা ফিরে তাকাই বালাকোটের দিকে। চারদিকের আঁধার ভেদ করে আলোর রেখা জ্বালবার সাহস পাই হৃদয়ে।
বালাকোটের ময়দানে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভীর যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াটাই ছিল সাহসের পরিচায়ক। ব্রিটিশ রাজ বা তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যায়, ভারতীয় মুসলমানরা এ যুদ্ধের মাধ্যমেই তা বুঝতে পারেন। ফলে সময়ের ব্যবধানে আমরা আরো অনেক প্রচেষ্টা দেখতে পাই। একের পর এক প্রচেষ্টার ফলেই একটা সময়ে ব্রিটিশরা হাল ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যায়।
বালাকোট যুদ্ধ পলাশীর কয়েক দশক পরের কথা। মূলত এ যুদ্ধ সাইয়েদ আহমাদের পরিকল্পনায় ছিল না।মূলত তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রনে থাকা পেশওয়ার নিয়ে বৃটিশদের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে কাশ্মীরের দিকে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। ইচ্ছা ছিল কাশ্মীরে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে দখল মুক্ত করবেন। সাইয়েদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে পথিমধ্যেই জনগণের ওপর শিখদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের খবর পান। এই খবর পেয়ে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। এ সময়ই শিখদের বিরুদ্ধে তাঁর সাহায্য চান বিভিন্ন এলাকার প্রধানেরা। ফলে তিনি কাশ্মীর সফর স্থগিত করে এ অবস্থার একটা বিহিত করার পথকেই বেছে নেন। ফলে যুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠে।
শিখ সেনাপতি রণজিৎ সিংয়ের ছেলে বালাকোটে আক্রমন করতে পারে, এমন খবর পেয়েই সাইয়েদ আহমদ ভুগাড়মুঙ্গ থেকে বালাকোটে ফেরেন। বালাকোটের জন্য তিনি চমৎকার যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সে যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে।
বালাকোটে ৭০০ মুজাহিদের বিপরীতে ১০ হাজার শিখ সৈন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারপরও মুসলমানরা যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেয়। ৩০০ মুজাহিদের শাহাদাত বরণের উল্টো পিঠে শিখ সৈন্য মারা যায় ৭০০ জন। মুসলমানদের সংখ্যয় কম থাকার পাশাপাশি সে যুদ্ধে রসদও কম ছিল। সাইয়েদ আহমাদ অনেকটা ওহুদ যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বালাকোটের কয়েকটি প্রবেশ পথে সাইয়েদ আহমাদ মুজাহিদদের প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত করেন। এসব প্রবেশ পথ বাদ দিয়ে বালাকোটে ঢোকা ছিল অসম্ভব। শিখরা অনেক ক্ষতি শিকার করেই সংখ্যাধিক্যের প্রাবল্য নিয়েই একটা সময় বালাকোটে প্রবেশ করে। বলা হতো, বালাকোটের মেটিকোট পাহাড় যার, সেই যুদ্ধে জয়ী হবে। ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই এমন কথা প্রচলিত ছিল।
শিখরা ১৮৩১ সালের ৫ মে মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করে। পরদিনই চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। ইসলামী শাসন কায়েমের বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে হয়তো সাইয়েদ আহমাদ সে সময় যুদ্ধ না করেই কাশ্মীরের পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সাইয়েদ আহমাদ পরাজয়ের প্রবল শঙ্কা মেনে নিয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
যুদ্ধের দিন ছিল জুময়া বার। সেদিন সাইয়েদ আহমাদ ব্রেরলভী তাঁর সহযোগী শাহ ইসমাইলকে নিয়ে সামনের সারিতেই ছিলেন। মেটিকোটের টিলা ছেয়ে ছিল শিখ সৈন্যদের দ্বারা। যুদ্ধে যে শিখ সেনারা নীচে নেমে আসছিল তাদের অধিকাংশই মুজাহিদদের হাতে নিহত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যা অনেক থাকায় শিখ সেনারা চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকে।
একটা পর্যায়ে মেটিকোটের ঝরণার মাঝে শাহাদাত বরণ করেন সাইয়েদ আহমাদ। শহীদ হন শাহ ইসমাইলও। সাইয়েদ আহমাদের মৃতদেহ শেষ পর্যন্ত পাওয়াই যায়নি। তাঁর শাহাদাতের খবর না জানা থাকায় তাঁকে খুঁজতে গিয়ে আরো অনেকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। মৃতদেহ না পাওয়া যাওয়ায় যুদ্ধের পরও অনেক মুসলমান তাঁর শাহাদাত নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
ঐ দিন তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাদেরই  প্রেরণায় ভারতে মুসলমানগণ আজাদী আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথক আবাসভূমি লাভে উজ্জীবিত হয়েছিলেন।

একই ভাবে নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের  ৫মে মতিঝিলের শাপলা চত্তরে একত্রিত হয়েছিলেন হেফাজত ইসলামের ব্যানারে বাংলার লাখো লাখো জনতা । দিন শেষে তারা নাস্তিকদের শাস্তির দাবিতে মতিঝিলে অবস্থান করার ঘোষনা দেন। রাত তখন ২টা কেউ ঘুমিয়ে, আবার কেউ এবাদতে রত, ঠিক এই সময়ে  ৬তারিখ ভোর হওয়ার পূর্বেই সাধারন মুসলমানদের উপর আওয়ামী সরকারী বাহীনির চরম নির্মমতা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মৃত্যু কূপে পরিনত হয় মতিঝিলের শাপলা চত্তর । সাধারন জনতার আত্মচিৎকারে রাজধানী ঢাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে । বাচাঁর জন্য কোন আকুতিই সেদিন সরকারী বাহীনির হৃদয় নরম করতে পারেনি,হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর পরিনত হয়েছিল গুলিবিদ্ধ মুসল্লিদের বিছানায়। সেখানেও তারা থাকতে পারেননি। অনেকে শহীদ হয়েছেন,কেউ আহত হয়েছেন,কাউকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে,আবার কাউকে চিকিৎসা না নিয়েই বাড়ী যেতে হয়েছে । সারাদেশের সাধারন মানুষরা শুধু ধিক্কার জানানো ব্যতিত কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি । দাবী আদায়ারে অনেক আন্দোলন আমরা দেখেছি, স্বদেশে আন্দোলন দমনের অনেক কৌশলও দেখেছি,কিন্তু সেদিন যা ঘটেছিল অতিতের কোন ঘটনার সাথে মিলানো সম্ভব হবেনা কারোই। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ নির্মমতা কারো কাম্য হতে পারেনা ।
ইসলাম এবং মুসলমানদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা আসলে যে ন্যক্কারজনক প্রতারণাপূর্ণ কৌশল নিয়েছিলেন সে বিষয়টাও পরিষ্কার হয়েছে। দেখা গেছে, মুখে না বললেও সর্বান্তঃকরণে তারা ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষই নিয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা অভিমুখী যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার নজির বিহীন ঘোষনা। বাস-ট্রাক থেকে লঞ্চ-স্টিমার শুধু নয়, ট্রেন এবং বিভিন্ন ঘাটে নৌযান চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল আওয়ামী সরকার। ১৯৭১ সালে প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, এবার লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রতিপক্ষ হয়েছে সরকার নিজেই। আর সরকারের নগ্ন রুপ প্রকাশ পেয়েছে ৬ মে ২০১৩ এর মধ্যরাতে! এর পূর্বে হেফাজতের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার পর কথিত শাহবাগি আন্দোলনের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ঘোষণা দেন, ‘শাহবাগ শান্ত হবে হেফাজতে ইসলামের রক্ত দিয়ে।’
সত্যি সত্যিই এই শাহবাগীরা রাষ্ট্রিয় শক্তির উন্মাদনায় হেফাজতের নিরস্ত্র লাখো জনতার রক্তের হোলি খেলা দেখে তারা এখন শান্ত কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষদেয় রক্তস্নাত কোন আন্দোলনই বৃথা যায়না। ক্ষরিত রক্ত থেকেই আন্দোলনের বীজ অংকুরিত হয়।
যেভাবে বালাকোটের রক্ত উপমহাদেশ থেকে বৃটিশদের বিতাড়নে পারম্ভিক আন্দোলন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল,রফিক সালাম জব্বার বরকতদের রক্ত যেভাবে পাকিস্তানী হানাদারদের বিতাড়নের পারম্ভিকা হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, একই ভাবে ধর্মপ্রান মুসলমানদের রক্তও ধর্মবিদ্বেশীদের বাংলার জমিন থেকে চিরতরে বিদায়ের  সুতিকাগার হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে।
লেখকঃ সাংবাদিক
সধযসবফপাপ@মসধরষ.পড়স




শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

খালেদা জিয়ার ওপর হামলা কেন?


মনির আহমেদ

বংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই অওয়ামীলীগের চরিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করে। অথবা বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকেই এই দলটির আসল চরিত্র জনগণের সামনে প্রকাশ পেতে শুরু করে। ক্ষমতাই আওয়ামীলীগের একমাত্র লক্ষে পরিণত হয়। এখন এসে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়াকে হত্যা করেই ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।
১৯৪৯ সালে ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ নামে যাত্রা শুরু করে এই সংগঠনটি। তখন সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয় টাঙ্গাইলের সামসুল হককে। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি নাম থেকে বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ করা হয়। তখন দলে মতানৈক্য দেখা দিলে ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী পদত্যাগ করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৫৪ সালে একবার যুক্তফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে ক্ষমতার খানিকটা স্বাদ পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও ১৬৭ আসন পায় দলটি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাকশাল গঠন করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। দেশের অভ্যন্তরে অসন্তোষের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।
২৫ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৪৬, জামায়াত ৩ ও স্বতন্ত্র ২টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগ।
জনগণের ওপর জুলুম-নিপিড়নের কারণে ২০০১ সালে ভরাডুবি হয় তাদের। ২০০৭ সালে নাটকীয় ১/১১ কে পুঁজি করে ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ।
এবার তারা ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে থাকে। একদিকে শুরু করে সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার, অন্যদিকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধের নামে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যার মিশন। সাথে সাথে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে নিজেদের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। শুরু হয় প্রতিবাদ, কিন্তু কোন ভাবেই তারা কারো কথাকে পাত্তা দিচ্ছেনা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ই নির্বাচন কমিশনের অধীনে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। বিরোধী দল অংশগ্রহন না করে তত্ত্বাবধায়কের দাবি নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
২৯ ডিসেম্বর ১৩’ মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ঘোষণা করে দেশের মানুষকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। বিক্ষুব্ধ জনতা যেন ঢাকা ঢুকতে না পারে সেজন্য সরকার ঢাকার চারিদিকে বাধার প্রাচীর তৈরি করে। সকল বাধা পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ খালেদার আহ্বানে ঢাকায় আসেন। সেদিন সকাল থেকেই সারা ঢাকায় অনেকটা অঘোষিত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর একটা অংশকে দেখলাম মাইকিং করতে। ‘আপনারা কেউ রাস্তায় বের হবেন না।’
যেখানে কোথাও ৫/৭জন একত্রিত হচ্ছে, সেখানেই পুলিশ তাড়া দিচ্ছে, গুলি করছে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষের হয়রানি। কী এক বিড়ম্বনা! মানুষের কথা বলার কোন স্বাধীনতা নেই, রাস্তায় অভয় নিয়ে চলার কোন ফুরসত নেই। শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারাদেশে হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার করা হয়।
বিরোধী দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সারাদেশে চরম বিরোধীতার মধ্য দিয়ে নামমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। যাতে ৫ শতাংশ ভোট পড়ে, যদিও সরকার পরে সেটিকে ৪০ শতাংশ দেখায়। সবচেয়ে হাস্যকর হলো প্রায় ৫৩ টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি।
তারপরও শতভাগ আসন পাওয়ার উল্লাস করে ক্ষমতাসীনরা। কোন বিরোধী দল নাই, যারা আছে তারা সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। বাহ! কী চমৎকার!
দীর্ঘ দিনের জুলুম-নির্যাতন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠে বিরোধী দল। তারা সরকারকে কিছুদিন সময় দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আন্দোলন শুরু করার চিন্তা করে আবার। এভাবে কেটে যায় এক বছর। এ বছরের ৫ জানুয়ারি অবৈধ নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। সরকার কোন ভাবেই করতে দিবেনা। পুলিশের অনুমতি মিলেনি সহিংসতার অজুহাতে। বেগম খালেদা জিয়া অনড় থাকেন, তিনি বের হবেন অফিস থেকে। সমাবেশ করবেনই। সারাদেশ থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় আসে। এক পর্যায়ে খালেদা বের হওয়ার পরিকল্পনা করেন, অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসেন। কিন্তু তার অফিসের গেট আটকে রাখা হয়। পুলিশের বেরিকেড ভেঙ্গে ভেতর থেকে গেট খোলার চেষ্টা চলে। সাথে সাথে পুলিশের পিপার স্প্রে নিক্ষেপের ফলে খালেদা জিয়াসহ অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বের হতে না পেরে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে অহ্বান জানান খালেদা জিয়া। অররোধের ঘোষণা দেন তিনি।
সেই থেকে খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ থাকেন তার অফিসে। অবরোধ, হরতাল ৯৩ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। হরতাল অবরোধে এই সময়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক মানবাধিকার সংগঠন, বিভিন্ন রাষ্ট্র সরাসরী সরকারকে আলোচনায় বসে সমস্যা সমাধান করার আহ্বান জানালেও সরকার কর্ণপাত করেনি। বরং উল্টো সৈয়দ আশরাফ মন্তব্য করে বসলেন, ‘দুই আনার মন্ত্রী, কাজের মেয়ে মর্জিনা।’ কে না বোঝে এসব ছিল সম্পূর্ণ শিষ্ঠাচার বহির্ভূত।
৬ এপ্রিল কালের কন্ঠের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, এফবিসিসিআই এর হিসাব মতে দেশে প্রতিদিন অবরোধে প্রায় ক্ষতি হয় দুই হাজার সাত শত কোটি টাকা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাব মতে দিনে ক্ষতির পরিমান দুই হাজার দুইশত আটাত্তর কোটি টাকা, যা অবরোধকালিন সময়ে প্রায় দুইলাখ কোটি টাকার বেশী।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এত পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্যেও সরকারের মাথা ব্যাথা হয়নি। একটা বিষয় স্পষ্ট, যদিও আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেছে, কিন্তু তারাতো জানে জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত নয়। সুতরাং জনগণের ক্ষতি হলেও তাদের কোন সমস্যা নেই।
এই সময়ে খালেদা জিয়ার ওপর চলে মানসিক নির্যাতন। মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়া হয়, যদিও তারা তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর তার মামলার দায়ভার হিসাবে স্ত্রী, কন্যাদের আসামী করা হয়। কোন পথেই যখন আন্দোলন থেকে ২০ দলকে ফেরানো যাচ্ছিল না, তখন সরকার ঘোষণা করে তিন সিটি নির্বাচন।
অনেকটা হঠাৎ করেই খালেদা জিয়া ৫ এপ্রিল আদালত থেকে জামিন নিয়ে গুলশানের বাসায় যান। রাজনীতিতে অনেকটা স্বস্তি আসে, তিন সিটিতে হরতাল-অবরোধ শিথিল করা হয়। যদিও গুঞ্জন আছে সরকারের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই এই নির্বাচনে যাওয়া ও আন্দোলন থেকে সরে আসা। যাক, সেটি ভিন্ন আলোচনা।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ তখন থেকেই ঘোষণা দিতে থাকেন খালেদা জিয়া নির্বাচনে ঢাকায় চষে বেড়াবেন। আস্তে আস্তে আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায় অনেকটা অজান্তেই। নির্বাচনে মির্জা আব্বাস, তাবিথ, মঞ্জুরের মননোয়ন বৈধ হওয়ায় নির্বাচনে কাজ শুরু হয়। পরিবেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।
খালেদা জিয়াও পরিকল্পনা অনুযায়ী গণসংযোগ শুরু করেন। গাত্রদাহ শুরু হয় আওয়ামী নেতা কর্মীদের। আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ড.হাসান মাহমুদ ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া গণসংযোগে বের হলেই তাঁকে ঘেরাও করা হবে। পরবর্তীতে অন্য আরেকটি পোগ্রামে তিনি বলেন, ঘেরাও করে ধোলাই দেয়া হবে। অন্যদিকে আওয়ামী বুদ্ধীজীবি মহল একটি পোগ্রাম থেকে জানতে চান, খালেদা জিয়া কোন হিসাবে গণসংযোগ করছেন । স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বাস পুড়িয়ে কীভাবে বাসে ভোট চান। খালেদা জিয়াই তাদের জন্য চক্ষুশুল!
১৯ এপ্রিল খালেদা জিয়া যান উত্তরায় গণসংযোগে। সেখানে আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কালো পতাকাসহ হামলা করে তার গাড়িবহরে। তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, খালেদা গণসংযোগ শেষে ফিরে আসেন।
২০ তারিখ তিনি কাওরান বাজারে যান। গণসংযোগের এক পর্যায়ে সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন গাড়ির পার্শ্বে দাঁড়িয়েই। হঠাৎ আক্রমন করা হলো গাড়িবহরে। খালেদা জিয়া গাড়িতে ঢুকে যান। পুলিশের উপস্থিতিতে ভাঙচুর করা হয় অর্ধশত গাড়ি। আহত হন সিএসএফ কর্মকর্তাসহ ১২ জন, মাথায় আঘাত পান ৫ জন। সে দৃশ্য যে কাউকে আতঙ্কিত ও বিচলিত করবে।
কিছুক্ষণ পরেই প্রধানমন্ত্রীর একটা বক্তব্য সবার নজরে এসেছে। তিনি বললেন, ‘সিএসএফ এর কোন অধিকার নেই গুলি করার। সব খালেদার নাটক। আর কত নাটক করবেন। আর কত জনগনের রক্ত নিয়ে খেলবেন।’ বাহ! কী চমৎকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য!
স্বরাষ্ট প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বললেন হামলার জন্য সিএসএফ দায়ী। প্রধানমন্ত্রী তনয় জয় বললেন জনগনের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ। কী সুন্দর সব কথা!
২১ তারিখ খালেদা জিয়া আবার ভাঙ্গা গাড়িবহর নিয়ে বের হলেন গনসংযোগে। রাত ৮টার দিকে ফকিরাপুলে আবার গাড়িবহরে হামলা করা হলো। তিনি সেদিন আর কোথাও না গিয়ে বাসায় চলে যান।
২২ তারিখ আবার গনসংযোগে হামলা করে সরাসরি খালেদার গাড়ি ভাংচুর, গুলি করা হলো। সিএসএফ সদস্যদের রাস্তায় ফেলে সাপের মত পিটানো হলো। সাবেক পুলিশের আইজিপিসহ অনেককে আহত করা হলো।

 অনেকে রক্তাক্ত হলো। হামলার ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হয় প্রথম দিন থেকে দ্বিতীয় দিন ভয়াবহ, ক্রমে এই হামলা আরো ভয়াবহ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, কেন তাঁকে গণসংযোগে বাধা দেয়া হচ্ছে। কেন তার ওপর হামলা করা হচ্ছে? কেন গুলি করা হচ্ছে? কেন রক্তাক্ত করা হচ্ছে তার নিরাপত্তা কর্মীদের? কেন পুলিশের সামনে ঘটনা ঘটলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? কেন হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে একটি টিয়ারশেলও নিক্ষেপ করা হলো না? কেন ঘটনা ঘটিয়ে আবার আওয়ামীলীগ নেতা মামলা করে? কেন আবার শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়ে বলেন, এগুলো নাটক?
তাহলে জনগণ কি ধরে নেবে সরকার পাকিস্তানের বেনজির ভূট্টোর মত খালেদা জিয়াকে হত্যা করার চেষ্টা করছে? খালেদাকে হত্যা করেই ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার স্বপ্ন দেখছে?

লেখকঃ সাংবাদিক
সধযসবফপাপ@মসধরষ.পড়স






রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরবে কে?


                                                              মনির আহমেদ
কুমিল্লায় দুই গ্রুপে সংঘর্ষে নিহত শহর সভাপতি সাইফুলের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকার ছবি

ছাত্রলীগ, ছাত্রসমাজের কাছে এখন এক আতঙ্কের নাম। ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র হত্যার মহা উৎসবে মেতে উঠেছে এই সংগঠনটি। কে বিরোধী আর কে নিজ দলের বাছাই করার সময় এই দলের ক্যাডারদের হাতে নেই। সংঘর্ষে লিপ্ত থাকা, অপরকে পিটিয়ে ছাতু বানানোই এদের কাজ। ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা এখন তাদের কাছে ডাল-ভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষক নির্যাতনেও বেশ এগিয়ে। এদের অপকর্মের তালিকা করতে বসলে তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতেই থাকবে।
আজকের লেখার এই শিরোনামটি তৈরি করে রেখেছিলাম চার মাস আগেই। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় সময় করতে না পারায় লেখা হয়ে উঠেনি। সাথে এই ভাবনাটিও অবশ্যই ছিল যে সত্য তুলে ধরতে গিয়ে কার চক্ষুশুল হতে হয়! কারা আবার কি মনে করে! আজ সিদ্ধান্ত নিয়েই লেখা শুরু করলাম।
ছাত্রলীগের এরা তো আমার দেশের সন্তান, আমাদেরই কারো ভাই, কারো আত্মীয়, কারো প্রতিবেশী। এরা হয়তো দেশের কল্যান ও ছাত্রসমাজের জন্য কিছু করার চিন্তা নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিল । দুঃখজনক হলেও সত্য, কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা আজ ছাত্রসমাজের অঘোষিত শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এসকল ছাত্রনেতাদেরই কেউ কেউ ব্যবহার করছে। সমাজে তৈরি করছে প্রতিহিংসার দাবানল, ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রুতা। ক্ষমতার মুলা সামনে ঝুলিয়ে ছাত্র রাজনীতির নবীন ছেলে বা মেয়েটিকে করে তুলছে অন্ধ। কেউ সমাজে পরিচিতি লাভ করছে ক্যাডার, আবার কেউ সন্ত্রাসী, কেউ অমুক-তমুক ভাইয়ের ডান-বাম হাত হিসাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আসা ছাত্রটি যে লক্ষ্য নিয়ে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বরং সে হয়ে উঠছে প্রতিহিংসাপ্রবন। কাকে টেক্কা দিয়ে কীভাবে ওপরে ওঠা যায়, এটাই চিন্তায় থাকে। সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে নিজেই শুধু ক্ষমতাধর হবে, অন্য কেউ যেন না হয়। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়েই নেতৃত্বের একটা জায়গায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের প্রত্যাশা নিয়েই শুরু হয়ে যায় অপরের সাথে দ্বন্দ।
গত ১১এপ্রিল কুমিল্লায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ ও সেক্রেটারী সিদ্দিকী নাজমুল আলম গিয়েছিলেন কর্মী সভা করার জন্য। মূলত সেখানে কাউন্সিল মিটিং কমিটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সভাপতি-সেক্রেটারীর উপস্থিতিতেই সেখানে সংঘর্ষ শুরু হয়। নেতারা কমিটি গঠন সম্পূর্ণ না করেই ফিরে আসেন। পর দিন মারা যায় সাইফুল নামের একজন। গুলির পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে সাইফুলকে ছুরি দিয়ে আহত করে তাদেরই অপর পক্ষ। সাইফুলের নিথর দেহ এমনভাবে রাস্তায় পড়ে ছিল তা যে কোন বিবেকবান মানুষেরই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে বাধ্য।
ঠিক যেভাবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে জামায়াত-শিবিরের মুজাহিদ, মাসুম, জসিমদের লাশ পড়েছিল। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বেশী কষ্ট অনুভব করেছি কারন সাইফুল আমর খুব পরিচিত ছিল। সাইফুল স্থানীয় এমপি বাহারের গ্রুপ করে, যারা মেরেছে সুমন দাসের নেতৃত্বে, তারা রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের গ্রুপ করে।
একই ভাবে ১৬এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায় হল দখলকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ও রংপুরের কিশোরগঞ্জ গ্রামের মিল্টন এবং বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও দিনাজপুর সদর উপজেলার বড় গুড়গোলা এলাকার জাকারিয়া নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ জন। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থা ছয়জনের।
দিনাজপুরের এই ঘটনাও ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীন কোন্দলের কারণেই হয়েছে।  সেখানে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রিয়েল ও সাধারণ সম্পাদক অরুণের সমর্থকদের সাথে ছাত্রলীগের রজ্জবের সমর্থকরা শেখ রাসেল হলের দখল নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
 এর আগে গত বছরের ২০ নভেম্বর শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শাবিপ্রবিতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে নিহত হন সিলেট সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সুমন। ২২ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় শিরোনাম হয়- “ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ, ৬ বছরে নিহত ৩৯”। সেখানে বলা হয়েছে এই হিসাব ২০০৯সালের ১ জানুয়ারী থেকে ২১ নভেনম্বর ২০১৪ পর্যন্ত। সেখানে আরো তুলে ধরা হয়েছে এ সকল কর্মকা-ের কারণে ছাত্রলীগ ১৬৩ জনকে বহিষ্কার করেছে। যদিও এ সকল বহিষ্কার শুধুই লোক দেখানো।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ফিল্মি কায়দায় ভারী অস্ত্র হাতে ছাত্রদের উপর আক্রমনের ঘটনা ঘটিয়ে বহিস্কার হয়েছিল যে তুহিন, সেই তুহিনই আবার পরে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্রেটারী হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অস্ত্রের প্রশিক্ষণের কথা মনে হয় সবারই কম বেশী জানা আছে। এর আগে আরো কত হত্যাকান্ড যে ঘটেছে এর কোন ইয়ত্তা নেই।
ছাত্রী নির্যাতনের কথা বলতে গেলে আসলে নিজেদেরকেই লজ্জিত হতে হয়। সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিকের সেঞ্চুরির ঘটনা সকলেরই মনে থাকার। আজো অবাক হই, মানিক সেঞ্চুরি করে মিষ্টি বিতরণ করে উৎসব পালন করেছিল! তখন মন্ত্রী পর্যায়ের একজন নাকি তার পিঠে চাপড়িয়ে বলেছিলেন, দুষ্ট ছেলে এসব করতে নেই! বাহ!
এই পয়লা বৈশাখে যা দেখালো তারা! টিএসসি, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ যতগুলো ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার সবকটিতেই ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা জড়িত। এ সকল গঠনায় নিজ দলের ৮ জনকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে। পর্দার অন্তরালে যে আরো কত কী ঘটছে!
ছাত্র-ছাত্রীদের নির্যাতনের পাশাপাশি শিক্ষকরাও বাদ যাচ্ছে না ছাত্রলীগের হাত থেকে। গত ১২ এপ্রিল ফেইজবুকের একটি কমেন্টের সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে তার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে লঞ্চিত করে ছাত্রলীগ। তার সাথে যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তা শুধু ছাত্রলীগ নয় পুরো ছাত্রসমাজকে লজ্জিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বানে বিচারের দাবিতে সেখানে একাডেমিক কর্মবিরতি চলছে। অন্যদিকে আবার ছাত্রলীগই সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফেইজবুকের কমেন্টের বিচার চেয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। শিক্ষক নির্যাতন করে আবার মামলা দায়ের!
গত নভেম্বর ২০১৪ হাবিপ্রবিতে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে বহিষ্কার করার পরে কয়েকজন শিক্ষকদের শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে শিক্ষকরা আবার বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নামেন। 
গত কিছু দিন আগে প্রশ্ন ফাঁস ছিল সকলের মুখেমুখে। এ ক্ষেত্রেও ছাত্রলীগই প্রধান ভূমিকায়, তা পত্রপাত্রিকার মাধ্যমে দেশের মানুষ জানতে পেরেছে।
এছাড়া অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা ঘটনা বারবারই ঘটিয়ে আলোচনায় এসেছে, আসছে ছাত্রলীগ।
হায়রে ছাত্ররাজনীতি! হায়রে ছাত্রলীগ! হায়রে মনুষত্ববোধ!
প্রশ্ন হলো, শুধু কি ছাত্রলীগই দায়ী? নাকি ছাত্রলীগের পাশাপাশি যারা তাদেরকে আজ বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজের কাজে ব্যবহার করছে তারাও দায়ী? ছাত্ররাজনীতি তো হবে ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতার জন্য, কল্যানের জন্য, ভবিষ্যত সৎ যোগ্য আদর্শ নেতৃত্ব তৈরির জন্য। এখনই যদি ছাত্র নেতারা প্রতিহিংসা, লুটপাট, দখলদারী, অনৈতিকতার সাথে জড়িয়ে যায়, তাহলে জাতি তাদের কাছ থেকে কি পাবে?
বর্তমানে ছাত্রলীগের যে অবস্থা, তাতে এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধের দাবি তোলা অস্বাভাবিক হবেনা। কিন্তু আওয়ামী সরকার ছাত্রলীগকে বড় আদরেই রেখেছে। এই সন্ত্রাসী সংগঠটির লাগাম টেনে ধরা আজ সময়ের দাবি। কিন্তু কে ধরবে? কারা সেই সাহসী?
লেখক: সাংবাদিক

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

বর্ষবরণ: অপসংস্কৃতিই যেন হয়ে উঠেছে সংস্কৃতি


                                                                মনির আহমেদ

বর্ষবরণ এখন যেন আর বর্ষ বরন নেই। তা যেন হয়ে উঠেছে উলঙ্গ উন্মাদনার এক মাধ্যম। এক ধরণের নোংরামি করে স্বরণীয় করে রাখার দিন। অন্যায় থেকে ফিরে থাকার শপথ নেয়ার পরিবর্তে অনেকে অনৈতিকতা আর নোংরামি দিয়ে শুরু করতে চায় দিনটি। বাঙ্গালী সংস্কৃতির চর্চার নামে মূলত এই সংস্কৃতিরই বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। নিজ সংস্কৃতির বিসর্জনে অপসংস্কৃতিই হয়ে উঠেছে বরণীয়।
বর্ষবরণের মত অনুষ্ঠান গুলোতে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে আমার খুব একটা যাওয়ার সুযোগ হয় না। ১লা বৈশাখ সাভারে গিয়েছিলাম। ব্যাক্তিগত কাজে। শুরুতেই আমাকে সময় দিয়েছেন আলাউদ্দিন ভাই। এরপর দেখা করি সাভার মডেল কলেজের অধ্যক্ষ জনাব তৌহিদুল ইসলাম স্যারের সাথে। যদিও তিনি স্যার, তবে আমার সাথে উনার সম্পর্কটা অনেকটা বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মত। অনেক বিষয়ে আলাপ করলাম। এক পর্যায়ে একটি পরামর্শও দিয়ে আসলাম। ‘আপনাদের কলেজের অনেক সুনাম সুখ্যাতি। আপনি চাইলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যা সর্বমহলে প্রসংশিত হবে।’
তৌহিদুল স্যার হাসলেন। বললেন, চিন্তা আছে।
মাহবুব ভাই, হাসান ভাইসহ কাজ শেষ করে যখন ফিরছিলাম, হেলাল ভাইকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চক্কর দেয়ার লোভ জাগলো। হেলাল ভাইসহ মোটর সাইকেল নিয়ে ঢুকলাম। আসলেই অনেক সুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে একটি হল আছে, যেটি কিনা এশিয়ার সর্ববৃহৎ হল! মীর মোশারফ হোসেন হলটি দেখতে বেশ সুন্দর। পনেরো শ’র বেশি ছাত্র থাকতে পারে এই হলে। এক এক করে ঘুরে ঘুরে সব দেখলাম। হেলাল ভাই অনেকটা গাইড এর ভূমিকায়।
চারুকলার তত্ত্বাবধানে সাং¯কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। অনেক দর্শক বসে দেখছেন। সবার মাঝে একটা নতুন নতুন ভাব। গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা। কেউ লাল-সাদা শাড়ি, কেউ সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে। হাতে ফুল মাথায় ফুলের বেনি, অনেকে এসছেন ছেলে মেয়েদের নিয়ে। এত সুন্দর ফুটফুটে ছেলে মেয়েদের দেখলে অনেক সময় লোভ হয় একটু কাছে যাই কোলে তুলে নেই, একটু আদর করে দেই। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন কিছু দেখানোর জন্য, কিছু শেখানোর জন্য। কিন্তু আসলে আমরা কী দেখাচ্ছি আর কী শেখাচ্ছি আমাদের সন্তানদের?
আমরা শিশুদের দেখাচ্ছি কীভাবে প্রেম-ভালোবাসার নামে বর্ষবরণের দিনেও বিশ্রীভাবে জোড়ায় জোড়ায় বসে কী করে আড্ডা দিতে হয়। কীভাবে পর পরুষ হয়েও মহিলাদের দিয়ে নিজের শরীরের উল্কি আকার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হতে হয়। রিক্সায় করে কীভাবে জোড়া মিলিয়ে ঘুরাঘুরির নামে নেশা খোরের মত সময় অতিবাহিত করতে হয়। পান্তা-ইলিশের নামে  কীভাবে সমাজে বৈষম্য তৈরির রাস্তাকে উন্মুক্ত করে তুলতে হয়। কীভাবে হোলি খেলার নামে রং মাখামাখি করে ছেলেমেয়েদের অন্যায় ছোঁয়াছুঁয়িতে মেতে উঠতে হয়।
বর্ষবরণের উদযাপনে দেখছি কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। রং হাতে নিয়ে আছে। সামনে কেউ হেটে যাচ্ছে, তার শরীরে রং মাখিয়ে দিচ্ছে খুব আলতো ভাবে। ছেলেও নিষেধ করছে না। একজন মেয়ের আলতো হাত শরীরে লাগছে, এটাতো কারো কারো কাছে অনেক বড় পাওয়া। এর ফলে কী হচ্ছে? স্পষ্টতই, সমাজে অনৈতিকতার চর্চা বেড়ে যাচ্ছে।
সন্ধায় যখন ফেইজবুক লগ ইন করলাম দেখি বন্ধুরা বিভিন্ন পত্রিকার লিংক শেয়ার করেছেন। ছাত্রী উত্যক্ত করার অপরাধে চানখারপুলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ছাত্রলীগ কর্মীকে মারধর, ছবি তুলতে চেষ্টা করায় ছাত্রলীগ কর্মী কর্তৃক সাংবাদিককে নাজেহাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ৩০/৩৫জন ছেলের একটি দলের দর্শনার্থী কয়েকজন মেয়েকে বিবস্ত্র করে অন্যায় আবদার পুরণের চেষ্টা
এবং এই কাজে বাধা দিতে গিয়ে আহত কয়েকজন, এক ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে বিবস্ত্রকরণ। আমরা ভুলিনি ১৯৯৯ সালে এরকম বর্ষবরণে রাত ১২.০১ মিনিটে বাঁধনকে বিবস্ত্র করার কথা। যদিও সংসদে দাঁড়িয়ে তখন জয়নাল হাজারীর মত ব্যক্তি উল্টো বাঁধনেরই বিচার দাবি করেছিলেন। মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে হিং¯্র জানোয়ারের ছবি, কার্টুন, ঢোল, তবলা, বাঁশিই যেন আমাদের মূল সংস্কৃতি!
অথচ শৈশবে দেখেছি ঠিক এর উল্টো চিত্র। নতুন বছরকে বরণ পুরাতন বছরকে বিদায় জানানোর উদযাপনে ছিল ভিন্ন আমেজ। এই দিনে সকাল বেলা মা বোনেরা কোরআন পড়ে শুরু করতো। অন্য দিন কোরআন না পড়তে পারলেও এদিন সবাই পড়তো। চিন্তা থাকতো আজ সারাদিন কারো সাথে কোন খারাপ আচরন করবে না, কাউকে দেখতাম রোজা রাখতে, কেউ রাত জেগে নামাজ পড়তেন। ইচ্ছা থাকতো গত বছরে জেনে না জেনে যে অন্যায় করেছি, মিথ্যা বলেছি, মানুষের অধিকার নষ্ট করেছি, তা থেকে মুক্ত হতে হবে। এজন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো, প্রতিজ্ঞা করতো নতুন বছরে এসব থেকে বেঁচে থাকার। মসজিদগুলোতে দোয়ার আয়োজন করা হতো। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা পুরাতন হিসাবের খাতা বাদ দিয়ে নতুন হিসাবের খাতায় লিখা শুরু করতো। হিসাব চুকিয়ে ফেলার জন্য হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো।  মানুষের মাঝে লেনদেন পরিশোধ করার জন্য এক ধরনের পেরেশানি লক্ষ্য করতাম। এসবই ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
 কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আমরা অতি আধুনিক হতে শুরু করেছি। বর্ষবরণ মানেই যেন নোংরামী। আমরা যেন এক নোংরা খেলায় মেতে উঠেছি। অতীত ঐতিহ্যকে হারিয়ে অনৈতিকতার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি।
 সচেতন যুব সমাজকেই এর জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবর্তনের আওয়াজ তুলতে হবে। আমরা নোংরামী চাই না, বৈষম্য চাইনা, অনৈতিকতা চাইনা, মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন দেখতে চাইনা। সংস্কৃতির নামে অসুস্থ্যতার সয়লাব দেখতে চাই না।
আসুন আমরা বাংলাদেশের আকাশে ভূতের মতন চেপে বসা অপসংস্কৃতিকে দূর করে সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতিকে আপন করে নেই। নববর্ষসহ জাতীয় দিবসগুলোকে নিজ সংস্কৃতির আলোকে উদযাপন করে অর্থবহ করে তুলি।

লেখক: সাংবাদিক

বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৫

ড. কনক সারওয়ার ॥ সাহসী সাংবাদিকতাই যার অপরাধ

                                                                মনির আহমেদ
জনতার কথা অনুষ্টান ধারনরত ড.কনক সরওয়ার

‘নেভার’, ‘অফকোর্স’ শব্দ দুটি দু’বার শুনলাম। এরপর একটু উঁচু গলায় কথা-বার্তা। ‘আপনি কোন আইনের বলে হাউজে ফোন করে আমার অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বললেন? আমাকে দেখান।’
‘আছে, আইন আছে।’
‘হ্যাঁ সেটাই তো জানতে চাচ্ছি, দেখান।’
‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি দেখাতে বাধ্য নই।’
এরপরই আরো উঁচু গলায় কথা বলতে শোনা যায়। ৬ জুলাই ২০১৩ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একুশে টেলিভিশনের জনতার কথা অনুষ্ঠানের রেকর্ডকৃত অংশ প্রচার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পরবর্তীতে জানতে চাইলে এ ধরণের আচরণ করেন জনসংযোগ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। কনক সরোওয়ার সেখানে সাহসিকতার সাথে ভূমিকা রাখেন ।
ড. কনক সারোওয়ার। একুশে টেলিভিশনের সাহসী, দক্ষ, যোগ্য ও চৌকষ সাংবাদিক। একুশে’র নিয়মিত আয়োজন ‘জনতার কথা’ অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় উপস্থাপক। বলা বাহুল্য, এই টিভি প্রোগ্রামটিতে জনসাধারণের মতের বহিপ্রকাশ ঘটে। সরকারী বিভিন্ন কার্যক্রমের সমস্যা ও সম্ভাবনাও তুলে ধরা হয়। এখানে সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের বা চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে মুক্তমত প্রকাশের সুযোগ পায় মুক্তকামী সাধারণ মানুষ। এ প্রোগ্রাম দর্শকের পছন্দের। তবে, শাষক গোষ্ঠীর পছন্দের যে নয়, তা আজ প্রমানিত। কেননা এই টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মন্ত্রী-এমপিদের থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসতে শুরু করে। স্বাভাবিক ভাবেই সরকারও এটাকে তাদের ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য হুমকি মনে করে।
সেই কারণেই কি গত মাসে গ্রেপ্তার হন কনক সারওয়ার? আসলে তার অপরাধ কী? তিনি কোন আইন ভেঙ্গেছেন? হাঁ, একটি আইনের আশ্রয়ে তার গ্রেপ্তারকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা সকলের কাছেই হাস্যকর ঠেকেছে।
জগদ্দল পাথরের মত জাতির বুকে চেপে থাকা অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জনতার কথাকে কনক সারওয়ার ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরেছিলেন। প্রকাশ পায় সরকারের হীন, ঘৃণিত সব কর্মকান্ড। কিন্তু ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে ওঠা সরকার তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। আর তাই গত ৩ মার্চ মঙ্গলবার ২০১৫ দুপুর ২ টায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি অগ্রহণযোগ্য অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে।
যুগে যুগে যারা সাহসের সাথে সাংবাদিকতা করেছেন তাদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচার, নির্যাতন, কারাবাসের মত ভয়াবহ নিপিড়ন। সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির জাগ্রত বিবেক। সাংবাদিকদের কলমের ধারালো তীক্ষè খোঁচায় মুখোশধারীদের আসল রুপ উন্মোচিত হতে থাকে। প্রকাশিত হতে থাকে মুখোশের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিপরায়ন, হিং¯্রতায় ঢাকা আবরণ। আর বরাবরই অপরাধীরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আক্রোশে ফেটে পড়েছে। লোভনীয় অফার কিংবা জীবনের ভয় দেখিয়ে বন্ধ করতে চায় সত্য পথে চলা জাগ্রত কলম সৈনিকের সাহসী পদচারণা।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারও অতীতের মত একই পথে হেঁটেছে। গলা টিপে গণমাধ্যম হত্যা করেছে। দেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যম দৈনিক আমারদেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টিভিকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সম্প্রচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে একুশে টেলিভিশন। ঠুনকো অভিযোগে এসকল গণমাধ্যম বন্ধ করে দিয়ে জনতার কথা বলার অধিকারকে হত্যা করা হয়েছে। উল্টো দিকে দালাল গণমাধ্যম এবং দলীয় মনোভাবাপন্ন অসৎ সাংবাদিকদের দিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
সবাই জানে, সরকার বড় ধরণের ভুল করে চলছে। আর যাই হোক, দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের কৃতিত্বের অধিকারী এই দেশের মানুষকে বোকা ভাবাটাও হবে চরম বোকামী। দেশের কোথায় কী হচ্ছে, তার নেপথ্যে কারা, তা এদেশের মানুষ খুব ভালো করেই জানে। কোন গণমাধ্যম কী কারণে বন্ধ হচ্ছে তা স্পষ্ট করে বলা না হলেও জনতার বুঝতে বাকি নেই। আড়ালের ঘটনা সচেতন প্রত্যেকেই অনুধাবন করছে।
যে দেশে ইজ্জত হারিয়েও বিচার পায় না অসংখ্য মা বোনেরা, সে দেশে পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে সরকার এত সোচ্চার; ভাবাই যায় না। পর্নোগ্রাফি হলো কি হলো না তার সত্যতা যাচাই না করেই গ্রেপ্তার করা হলো ইটিভি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুস সালাম ও সাংবাদিক কনক সারওয়ারকে।
এর আগেও আমরা সরকারের এমন অনেক বিতর্কিত কা- দেখেছি। জাতির সুযোগ্য সন্তানদের আইনের নামে বেআইনিভাবে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাহসী কলম যোদ্ধা, আমারদেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তা জনগণ ভুলে যায়নি। সরকারের অপকর্ম জাতির সামনে তুলে ধরার অপরাধেই মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের একজন বিচারপতির কথোপকথন পত্রিকায় ফাঁস করার অভিযোগ ওঠার পর মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দু’টি মামলা হয়েছিল। এইসব মামলা যে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, তা বাংলাদেশের মানুষ ভালো করেই জানে।
মাহমুদুর রহমানের ওপর কী ধরণের নির্যাতন চালানো হয়েছে, তাও সবাই জানে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের দালালি না করলেই তার ওপর খড়গ নেমে আসে।
নিজ বাসভবনের বেডরুমে খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহরুন রুনি। হত্যাকা-ের বিচার তো দূরের কথা, মামলার কোন ধরণের অগ্রগতি পর্যন্ত নেই। কেন, কারা তাদের খুন করছে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন আসে, এ হত্যাকা-ের পেছনে কি তবে রাষ্ট্রীয় মদদ রয়েছে।
সরকারের দূর্নীতি, অপরাধ, জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান না করে সমানতালে সমর্থন করতে পারলেই সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পায়। এর ব্যতিক্রম হলে হয় গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেপ্তার হন সত্যপথের সাহসী সাংবাদিক, সম্পাদক। এসব আর কত দেখতে হবে আমাদের? কোন নিস্তার কি পাব না? কেউ কি জেগে উঠবে না অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে?
##

শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিন: যে স্মৃতি হৃদয়ে নাড়া দেয়

                                                             মনির আহমেদ
শহীদ আসাদুল্লাহ মাহফিলের সেচ্ছাসেবক হিসাবে

‘‘আমার কাছে মনে হয় আমার বাবা মরে নাই। সে সবসময় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এখনো বলে, যাচ্ছি মা। আবার ফিরে এসে বলে, কী করছ মা। আমার চারপাশে ঘুরাঘুরি করে। মনে হয় এই বুঝি আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। আর আমি বলছি, সাবধানে যাস বাবা।’’
বলছিলেন শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিনের মা কমেলা বেগম। পুত্র হারানোর শোকে কাতর এই মা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। তবে এখনো তিনি বুঝতে পারেননি কেন তার সন্তানকে র‌্যাব তার চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে ।
গত ১৯মার্চ সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে। সাথে ছিলেন রাশেদুল হাসান ভাই। কয়েক দফা বাস পরিবর্তন করে পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা ছয়টা। পৌঁছে প্রিয় ভাই গোলাম মোস্তফা, তহুরুল ইসলাম সোহেলসহ পরিকল্পনা করি পরের দিনের শিডিউল নিয়ে- সকালে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, পরবর্তীতে শহীদ আসাদুল্লাহ তুহিনের কবর জেয়ারত,  এরপরে অন্যান্য।
পরদিন পরিকল্পিত শিডিউল মেনেই কাজ শুরু হলো। প্রথমে অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। এরপর এক বাসায় নাস্তা খেয়ে করব জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা দিই। গিয়েই দেখি আগে থেকেই আমাদের যাওয়ার খবর শুনে শহীদের সম্মানিত পিতা জনাব মো. একরামুল হক ও মামা কবির হোসেনসহ এলাকার অনেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেখেই প্রথমে শহীদের বাবাকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরি। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। শান্তনা ব্যর্থ হলো।
শহীদের কবর জেয়ারত
কবর জেয়ারত শেষে মোস্তফা ভাইকে বললাম, মায়ের সাথে দেখা করবো। বাসায় গেলাম। বাবা-মা এবং মামার কাছ থেকে শুনতে থাকলাম আসাদুল্লাহ তুহিনের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা। তিন ভাই এক বোনের মাঝে তুহিন ছিলেন সবার ছোট। ছোট থেকে অতি আদরে বড় হয়েছিলেন। বড়ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর পারিবারিক বস্তবাতায় আর পড়াশোনা করতে পারেননি। মেজো ভাই এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর আর পড়তে পারেননি। সবার আশা ছিল তুহিন পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। তাদের বংশের মুখ উজ্জল করবে। সে জন্যই তাকে সব সময় সবাই নজরে নজরে রাখতো। সবাই সহযোগিতা করতো।
শহীদের মা বাবার সাথে লেখক
মামা জানালেন, ‘তুহিন টাকা চেয়ে পায় নাই এমন কোন ঘটনা আমরা ঘটতে দেইনি। মা বললেন, যত সমস্যাই থাকুক সে প্রতিদিন স্কুলে যেতো। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও কখনও কলেজ কামাই করতে তাকে আমরা দেখিনি। রওয়ানা দিয়েই বলতো, মা যাচ্ছি। আবার ফিরে এসে কী করছি জানতে চাইতো।’
বলতে বলতে মা’র চোখ থেকে জল গড়ায়। মা’র কাছে জানতে চাইলাম, এমন কোন আচরণ কি আপনার মনে পড়ে যা আপনাকে আনন্দ দিত।
মা বললেন, ‘তার বাবা অথবা আমি যদি কখনো কোন বিষয়ে বকা দিতাম, ধমক দিয়ে কথা বলতাম, সব সময় মাথা নীচু করে দাড়িয়ে শুনতো। কখনো উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতো না। গ্রামের কেউ বলতে পারবেনা যে সে কারো সাথে কখনো খারাপ আচরণ করেছে। সবাই তাকে ভালোবাসতো। সেও সবাইকে শ্রদ্ধা করতো। ছোটদের আদর করতো। যে কোন সিদ্ধান্ত নিলে সে বিষড়ে সে অনঢ় থাকতো। তাকে কোন কাজ দিলে ঠিকভাবে করতো।’
মামা বললেন, ‘সে যে একাদশ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সিটি কলেজ শিবিরের সভাপতি ছিল, এটা আমিও জানতাম না। আর প্রথমে শুনেও বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ আমি জানি কলেজ সভাপতি হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়, এরা সিনিয়র হয়। মনে হয় প্রশাসনের কাছে এ দায়িত্বই তার বড় অপরাধ ছিল।’
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তুহিনের উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। দেহ ছিল সুঠাম। তাকে অনেকে বলতো, তুমি তো সেনাবাহীনিতে দাঁড়ালেই টিকে যাবে। এসব জানলাম তার দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে।
তুহিন নিজেও নাকি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ সেবায় ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০১৩ সালে সে সেনাবাহিনীতে পরিক্ষা দিয়ে টিকেছিল। তখন তার কাছে সাড়ে চার লাখ টাকা চাওয়া হয়। তুহিন বলেছিল, আমার বাবা দরিদ্র মানুষ। এত টাকা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।
এর পর তুহিন চাকরির আশা ছেড়ে দেয়। ২০১৪ সেশনে আবার সেনাবাহিনীর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সে আবেদন করে।
তুহিনের মামা কবির হোসেন বলেন, ‘হঠাৎ একদিন সে আমার মোটরসাইকেলের সামনে দাড়িয়ে আমার হাত ধরে কাঁদতে শুরু করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী হয়েছে? কেউ কি কিছু বলেছে? বললো, না। আবার জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো, মামা সেনাবাহীনিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, কিছু টাকা খরচ হলেও আপনি আমাকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেন। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আবেদন করো, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার কথা শুনে সে মহা খুশি। দুইতিন দিন পর বলে, মামা আমাকে ৪০০টাকা দেন। কেন জিজ্ঞেস করতেই বললো ২টা ট্রাউজার কিনবো। পাড়ার দুইজন গত বছর সেনাবাহিনীতে টিকেছে, তারা ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। এখন থেকেই তাদের কাছ থেকে ট্রেনিংয়ের বিষয়গুলো নিয়মিত দেখে নিতে পারলে পরে কষ্ট কম হবে। সেই আবেদনের পর গত ফেব্রুয়ারী মাসের ২ তারিখ ওর বাছাইয়ের জন্য রাজশাহী রেঞ্জে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। ২৭ জানুয়ারী ওর লাশ পাওয়া গেল হাসপাতালের লাশ ঘরে।’
এ বছরের ২৬ জানুয়ারী সকালে তুহিন মামার বাসায় গিয়েছিল মটোরসাইকেলের জন্য। কোথায় নাকি যাবে চিন্তা করেছিল। তারা তিন জন। মামা বলেছিলেন, এক জনের বেশী মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলে পুলিশ রাস্তায় আটকাবে। তাই তিনি সাইকেল না নিতে বলেন। সেখান থেকে এসে সারাদিন আর বের হয়নি তুহিন। অথচ ২০১৩-১৪ সালের এই সময়ে সে বেশীর ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতো। দেশের পরিবেশ ভাল ছিল না। সে সময় যে বাড়িতে প্রশাসনের লোক যেতো, কাউকে না কাউকে ধরে নিয়ে যেতো।
বেলা তখন পৌনে তিনটা। দুপুরে খাওয়া শেষ করে তার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিল তুহিন। হঠাৎ বাসার সামনে এসে ২টা র‌্যাবের গাড়ি থামে। সাথে সাথে গাড়ি থেকে সবাই লাফিয়ে নেমে তুহিনের শোবার রুম ঘেরাও করে ফেলে। গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তন্ন তন্ন করে তাদের থাকার ঘর, পাকঘর সব খোঁজা হয়। র‌্যাব জামায়াত নেতা নূরুল ইসলাম বুলবুলের নাম লেখা একটি ক্যালেন্ডার ও ক্রিকেট খেলার ব্যাট, স্ট্যাম্প পায়। র‌্যাবের একজন বলে, বুলবুলের এক নম্বর লোক পাওয়া গেছে। এরপরই শুরু হয় তুহিনের ওপর নির্যাতন। সবার সমানে স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে মারতে তিনটা স্টাম্পই ভেঙ্গে ফেলে। র‌্যাব সদস্যরা জিজ্ঞেস করে, কোথায় অস্ত্র রেখেছিস বল? তুহিন বলে, আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই। র‌্যাবের একজন তুহিনদের গাছ থেকে লেবু পেড়ে বলে, এখন স্বীকার করবে না, যখন চামড়া ছিলে ছিলে লবন, লেবুর রস লাগাবো তখন স্বীকার করবে। অন্য একজন ভাঙ্গা স্ট্যাম্পগুলো তার মায়ের দিকে ছুড়ে মেরে বলে, লাকড়ি করার জন্য এগুলো রেখে গেলাম।
আমি ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হই। কী অসভ্যতা! কী বর্বরতা! তুহিনের মামা সাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ছবি দেখায়। তুহিনের শরীরের চামড়া কেটে সত্যিই লবন-লেবুর রস লাগানো হয়েছিল। তুহিনকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর রাতভর তার উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন । নির্মম নির্যাতনের ফলে সে রাতেই তুহিন শাহাদাত বরণ করে। মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর র‌্যাব তার লাশ সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
নির্যাতনের চিহ্ন
পরবর্তীতে র‌্যাব অজ্ঞাত ট্রাক চালককে আসামী করে মামলা করে। সেখানে তারা উল্লেখ করে, রাতে তুহিনকে নিয়ে যখন বের হয়, তখন সে পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফ দিলে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাক তাকে চাপা দিয়ে চয়ে চলে যায়। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, ট্রাক চাপা দেয়ার তো কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। বরং আপনাদের নির্যাতনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে । র‌্যাব তখন জানায়, উপর থেকে যেভাবে নির্দেশ দেয়া আছে, সেভাবেই বললাম। আমাদের এর বাইরে কিছ’ বলার নাই।
হায়রে র‌্যাব! হায়রে অজ্ঞাত ট্রাক চালক! হায়রে আমাদের স্বাধীনতা!
সেদিন সকাল বেলায় র‌্যাব স্কুলের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা চলাকালীন সকাল ৯টায় স্কুল মাঠ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফুলকুড়ি স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র আল-আমিন ও রাফিকে। অপর দিকে হেফজুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসা হোষ্টেল থেকে দুপুর ২টায় গ্রেপ্তার করা হয় আলীম প্রথম বর্ষের ছাত্র মেহদি হাসানকে। আসাদুল্লাহ তুহিনকে নিয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। র‌্যাব ক্যাম্পে সবাইকে একাত্রে রাখা হয়েছিল। একে একে সবাইকে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনকালে এক র‌্যাব সদস্য বলে, তোদের জীবন এখানে শেষ, যা সবাই অজু করে আয়। সবাই যেতে চাইছিল না, কিন্তু আসাদুল্লাহ তুহিন সাথে সাথে গিয়ে থেতলানো শরীর নিয়ে পাশ্বের পানি দিয়ে অজু করে নেয়।
এরপর সবার ওপর আবার নির্যাতন চলে। বিদ্যুত শক দেয়া হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত করে লবন-লেবুর রস লাগিয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে সবাইকে র‌্যাব অফিসারের পা ধরে মাফ চাইতে বলে। বাকি সবাই মাফ চাইলেও তুহিন তখনও বলেছে, আমি আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করতে পারবো না। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি কেন মাফ চাইবো?
তার দৃঢ়তা দেখে র‌্যাব সদস্যরা আবার নির্যাতন চালাতে থাকে। বাকী তিন জনকে পরদিন থানায় দিলেও তুহিনের লাশ দেয় হাসপাতালে। পরবর্তীতে নির্যাতনের শিকার অন্যরা এসব ঘটনা জানায়।
আমরা মনে হয় নিজের দেশেই পরাধীনতার জিঞ্জির পরে আছি। বর্বর সব ঘটনার কথা আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়। স্তম্ভিত হয়ে যাই। যারা এই ছেলেদের নির্যাতন করছে, তাদের কি বৌ-বাচ্চা, ভাই-বোন নেই? তাদের কি একটুও মায়া হয় না? হয় তারা বিবেকহীন, আর না হয় রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে তারা অভিশপ্ত। আল্লাহ তাদের অন্তর থেকে মায়া উঠিয়ে নিয়েছেন।
কথা শেষ করে তুহিনকে যে রুম থেকে নিয়ে গিয়েছিল সেটি দেখে আমরা বের হই। মা’কে বললাম, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। যেন আমরা তুহিন যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করতো, আমরা যেন সে লক্ষ্যপানে পৌছতে পারি। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বলছেন, বাবা তোমাদের জন্য দোয়া করি। সবার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেন তোমাদেরকে জালিমের হাত থেকে হেফাজত করেন। তোমাদের ইচ্ছা যেন আল্লাহ পুরণ করেন।
##

বুধবার, ২৫ মার্চ, ২০১৫

আমাদের স্বাধীনতা পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত নয়


আমরা স্বাধীন। এই কথা হৃদয়ে ধারণ করি, গর্ব অনুভব করি। কিন্তু তবুও একটা কষ্ট। মনে প্রশ্ন আসে- আমরা কি সত্যিই স্বাধীন। স্বাধীন বাংলাদেশ গান গেয়েও তো দেখি এই জনপদের অনেক মানুষ মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারছে না। বলতে হয়, আমরা স্বাধীন। কিন্তু পরাধীনতা এখনো বারবার আমাদের স্বাধীনতায় ছোবল মারে।

সেদিন খুলনা যাচ্ছিলাম। কাওয়াকান্দি থেকে মাইক্রো সার্ভিসে উঠলাম। ছোট একটা গাড়ি। নয়টা সিট, কিন্তু আমরা বসলাম ১৮ জন। কিছুই করার নাই, যেতে হবে। সুতরাং তারা যেভাবে নেয় সেভাবেই যেতে হচ্ছে। কোন প্রশ্ন করা মানে বিপাকে পড়া। করলেই সোজা জানিয়ে দেবে, ‘আপনি যাবেন? গেলে যান না হয় অন্য গাড়ীতে আসেন।‘ আসহায় মনে হয় নিজেকে!
এই শ্রেনীর মানুষদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি। একটু খোঁজার, তলিয়ে দেখার প্রয়াস পেলাম। দেখা গেল ১৮ জন থেকে ৫৫০০টাকা তারা ভাড়া নেয়। কিন্তু ড্রাইভারের হাতে দেয়া হয় ৩২০০ টাকা। বাকি টাকা? বিষয়টি সবার কাছেই দিনের আলোর ন্যায়মত স্পষ্ট। এমপি সাহেবের ভাগ, পরিচালনা কমিটি, এলাকার বড় ভাই সবাইকে এখান থেকে একটা অংশ দিতে হবে। একই ভাবে গত ঈদের আগের দিন স্পিড বোটে করে যাচ্ছিলাম। সব সময় ভাড়া নেয় ১৫০, সেদিন নিল ২৫০ টাকা। বোটের চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ১০০ টাকা যে বেশী সেটা কি তোমরা পাবে? তার উত্তর, ‘না ভাই আমরা যা পেতাম তাই পাব। বাকিটা মন্ত্রী, এমপি, ঘাটের খরচ।‘
বলছিলাম খুলনা যাওয়ার সময়ের কথা। মাইক্রোতে বেশী লোক বসায় এক জনের পায়ের সাথে অন্য জনের পা লাগছিল। সবাই স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিচ্ছিল। শুরু হল কথা। একজন সিরিয়ার কথা তুললেন। বললেন, ‘সেখানে মানুষদের জীবন যাপন নিয়ে। বাশার আল আসাদ অনেক দিন থেকে সে দেশের প্রেসিডেন্ট। মানুষের স্বাধীনতা বলতে গেলে নাই-ই। জোর যার মুল্লুক তার। এভাবেই চলছে তাদের সব কিছু, প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যা বরাদ্দ তা দিয়েই চলতে হয়। এমনকি পানি পর্যন্ত সরকারের নিকট থেকে বরাদ্দ।‘
আমি জানতে চাইলাম, ভাই তারা টিউবওয়েল বসায় না কেন? লোকটির উত্তর, ‘মাটি খোঁড়াও নিষিদ্ধ! টিউবওয়েল বসানোর তো প্রশ্নই আসেনা।‘
‘পুরুষ মানুষের বয়স ১৮ এর বেশী হলে অধিকাংশকে হত্যা করা হয়, কারণ তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে। মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারে। এজন্য সেখানে পুরুষরা যারা বেঁচে থাকে তারা কোন কাজ করে না। বাইরে বের হলে গুলির মুখে পড়তে হতে পারে, তাই ক্ষেত-খামারের কাজ থেকে শুরু করে সব কাজ মহিলারাই করে। আইন-আদালত বলতে গেলে নাই। যাকে ভাল লাগছেনা গুলি করে হত্যা করছে। দেশ কয়েক  ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষ সরকার, এক পক্ষ সেনাবাহিনী, এক পক্ষ বিরোধী দল। যে যার মত করে চলছে। কাউকে ভাল না লাগলে গুলি করে হত্যা করছে। সখানে সবার কাছে অ¯্র থাকা বৈধ। সুতরাং কোন ঘটনা ঘটলে অস্ত্র নিয়েই সবাই বের হয়। কোন বিচার ব্যবস্থা সেভাবে নেই।‘
যার কাছ থেকে শুনছিলাম তিনি মিশনে গিয়েছেন কয়েকবার। সিরিয়ায় তার বেশ কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছে। সিরিয়ার এ অবস্থার কথা যখন ভাবি, তখন মনে হয় আমরা বেশ স্বাধীন আছি। এখনো আমাদের পুরুষরা বের হয়ে কাজ করতে যেতে পারে। হয়তো বিরোধী দল ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং করতে পারছেনা। কিন্তু তাতে কি! আমরা তো বাজারে যাই, কাজ করি। হয়তো সংবাদপত্র সম্পাদক, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার চেয়ারম্যানদের ডেকে সরকারের পক্ষে থাকার জন্য হয়তো হুমকি দেয়া হচ্ছে, হয়তো সঠিক কথা না বলতে সুশীল সমাজকে নিষেধ করা হচ্ছে, হয়তো গ্রহনযোগ্য নির্বাচন না হলেও ক্ষমতা ছেড়ে পুনরায় নির্বাচন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে, হয়তো পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির কর্তা ব্যাক্তিদের পছন্দ মত নিয়োগ দিয়ে বিরোধী দল দমনে সরকার তাদের ওয়াদা করিয়ে নিচ্ছে, হয়তো রাষ্ট্রীয় বাহিনী কাউকে হত্যা, কাউকে গুম, কাউকে গ্রেপ্তার করে কারান্তরীন করছে; কিন্তু তারপরও আমরা যে এখনো টিউবওয়েল বসিয়ে পানি তুলে খেতে পারছি! রাস্তায় ভয় নিয়ে হলেও চলতে পারছি। সেটাই বা কম কীসে?
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে স্বাধীন শব্দের অর্থ দেয়া আছে- ১.বাধাহীন; আজাদ; মুক্ত; স্বচ্ছন্দ(স্বাধীন গতি) ২.নিজের বশে; অনন্যনির্ভর (স্বাধীন মতামত) ৩.সার্বভৌম; বিদেশী দ্বারা শসিত নয় এমন।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে “স্বাধীন - স্বাধীনতা” শব্দের অর্থের কোন মিল আছে বলে আমার মনে হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, কেন এই পরিস্থিতি? আমরা কেন পরনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিনা? ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণের চেয়ে কেন অন্য রাষ্টের নেতৃত্বকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে? কেনইবা অবৈধ নির্বাচনের বৈধতার সমর্থন পাওয়ার জন্য নিজের দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সুযোগ করে দিতে হবে? এসব বিষয় সন্দেহাতীতভাবে আলোচনার দাবি রাখে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মুসলামানরা বড় একটা সময় পৃথিবী শাসন করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বশেষ মুসলিম শাসক ছিলেন নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা। সেই ১৭৫৭ সালের কথা। লর্ড ক্লাইভদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা পাওয়ার জন্য মুসলিম শাসকদের ভেতরে থাকা বৃটিশদের চর ঘসেটি বেগম, মীরজাফররা সেদিন বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। পরাজিত হয়ে ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গিয়েছিল মুসলিম শাসন আমল। কিন্তু মুসলমানরা অপ্রতিরুদ্ধ জাতি, পরাজয় তারা কখনো মেনে নিতে পারে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে তারা সব সময় এগিয়ে গিয়েছে। যদিও প্রায় দুইশত বছর আমাদেরকে ইংরেজদের কাছে পরাধীন থাকতে হয়েছে। কিন্তু অব্যাহত প্রতিরোধ ও বিরোধীতায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে এক সময় তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এর আগেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী  দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন। তখন মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে তারা শুধুমাত্র হিন্দুদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়নি। গড়ে ওঠে হিন্দু জনপদ নিয়ে হিন্দুস্থান ভারত। আর মুসলমান জনপদ নিয়ে মুসলমানদের কল্যাণ রাষ্ট্র পাকিস্তান । কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমরা যারা পূর্ব পাকিস্থানের অধিবাসী ছিলাম, স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে থেকেও অনেকটা পরাধীনের মতই ছিলাম। শারমিন আহমেদ ‘নেতা ও পিতা‘ বইয়ে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য ২২মার্চ ১৯৭১ আওয়ামীলীগ নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ লিখে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন আপনি স্বাক্ষর করে দিন। তিনি তখন বলেছিলেন তুমি কি আমাকে দেশদ্রোহী বানাতে চাও? এখানে স্বাক্ষর করা মানে তারা আমাকে রাষ্ট্র দ্রোহী মামলা দিয়ে জেলে নিবে। হতাশ হয়ে তাজ উদ্দিন ফিরে এলেন।’
২৫ মার্চ কালো রাতে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন এবং বাংলার মানুষের উপর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা শুরু হয়। ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যুদ্ধ শূরু হয়।
১৭ এপ্রিল অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের কাঠামো গঠিত হয়ে পূর্নাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী, ভারতের সরাসরি তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী এবং কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী যুদ্ধ করে। সেটি ভিন্ন আলোচনা।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলার পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকাল ৪.৩১ মিনিটে জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী বাহিনী ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার কাছে আত্মসমর্পন করে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু তখনই ভারতের কাছে যে আমাদের পরাধীন থাকতে হবে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক’দিন আগেও ভারত মওকা মওকা ভিডিও তৈরি করেছে। সেখানে তারা বুঝাতে চেয়েছে তারা বাংলাদেশকে আমাদের দান করেছে! যুদ্ধের পর ভারতীয় বাহিনী প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ন সব সম্পদ নিয়ে যায়। আমাদের দেশকে পরিণত করে তলাবিহীন ঝুড়িতে। আমাদের দেশ পরিণত হয় তাদের বাজারে।
আমাদের দেশীয় প্রতিনিধির হাতে শাসন ক্ষমতা এলেও মূলত ইংরেজ শাসন আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার নামে আমাদের গোলামী ও পরাধীনতার হাত বদল হয়েছে মাত্র! বর্তমানে আমরা স্বাধীন হয়েও আধিপত্যবাদী ভারতের ছোবলের শিকার হচ্ছি।
পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন যেমন গৌরবের, তেমনি ভারতের আধিপত্যবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়াও অনেকটা লজ্জার। যা বর্তমান প্রজন্ম এখন কিছুটা বুঝতে শুরু করেছে। 
এই আধিপত্যবাদের হাত থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের প্রয়োজন গনতন্ত্রের সঠিক চর্চা। প্রয়োজন বিরোধী মতের যথাযথ মূল্যায়ন। প্রয়োজন সাহসী পদক্ষেপের, সৎ দক্ষ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বে। প্রয়োজন জনগণের অংশগ্রহনমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক


ছাত্ররাজনীতিঃ লেজুড়বৃত্তিতে বাড়ছে অবক্ষয় -২য় পর্ব




গত ডিসেম্বর২০১৪ সংখ্যায় যেখানে শেষ করেছিলাম দুটি লাইন উল্লেখ করেই আজকের অংশটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
‘একজন সচেতন মানুষ কখনোই একটি টেপ রেকর্ডারের মত নয়। একটি টেপ রেকর্ডার যে কোন কিছু ধারণ করে হুবহু তা তুলে ধরে। সচেতন যে কোন মন কোনকিছু শোনার পর তা যাচাই করে নেয়। নিজের বিবেচনা বোধকে কাজে লাগিয়ে কোন কাজে যুক্ত হয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির সাথে আজ যারা যুক্ত, তাদের মাঝে এ বিবেচনা বোধ আছে কি?’
ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব আমাদেরই। আর এজন্য আমাদের এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

ছাত্র রাজনীতি কেন প্রয়োজন?
যদিও নিকট অতীতে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি তুলেছেন অনেকেই, কিন্তু প্রায় শতভাগ মানুষই এই রাজনীতির প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নেন। ছাত্র রাজনীতি যেমন ছাত্র সমাজের জন্য প্রয়োজন, তেমনিভাবে দেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ চিন্তাকে সামনে রাখলেও এ রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা পরিস্কার হয়ে যায়।
ক.ছাত্রসমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন
আজ যারা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসায় পড়ছে, তারা প্রতিনিয়তই নানা ধরণের সমস্যা মোকাবেলা করে পথ চলছে। ছাত্র সমাজের যে কোন সমস্যাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে ও তা সমাধানের লক্ষে পৌছানোর জন্যই ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন। ধরুন, একটি কলেজে কোন ধরণের রাজনীতি নেই। সেই কলেজে হাজারো সমস্যা রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই কলেজের এসব সমস্যাকে তুলে ধরে প্রতিকারের দাবি নিয়ে উচ্চবাচ্য করার মত তেমনভাবে কেউ এগিয়ে আসছে না। ছাত্রদের আবাসন, শিক্ষার পরিবেশ, সামর্থের আলোকে বেতনাদি নির্ধারণ, এসব বিষয় নিয়ে ছাত্রদেরই তো সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকতে হবে। আর সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বিষয়টিই ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনকে স্পষ্ট করে।

খ.শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা
অবক্ষয়ের ফলে আজ ছাত্র রাজনীতি যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে অনেকেই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকার পেছনে এই রাজনীতিকেই দেখতে পান। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেয়াই কি এর সমাধান। নাকি ছাত্র রাজনীতিকে সঠিক পথে ফেরানো? মূলত, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের জন্যই ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজন। রাজনীতি হলো একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিরা সামনের সারিতে চলে আসেন। তারাই সমাজ ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমনি। যোগ্য ছাত্ররা নেতৃত্বে আসে ও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সচেষ্ট থাকে। ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফলে আজ অনেক ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীকে সামনের সারিতে দেখতে পাই। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, যোগ্য ছাত্র কোন শিক্ষাঙ্গনে নেতৃত্বে থাকলে সে অনেক ছাত্রকে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা দিতে পারে। ছাত্রদের মেধার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসসহ নানা সমস্যার থাবা থেকে রক্ষা করতে পারে। ফলে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করে।  
গ.গনতন্ত্র চর্চার শিক্ষা ক্ষেত্র
গণতন্ত্র এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। এই পদ্ধতি শুধু রাষ্ট্রের জন্যই যে প্রয়োজন, তা নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ, রাষ্ট্রের ভেতরের নানা পর্যায়ে এর চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি একজন ছাত্রকে গণতন্ত্র মনস্ক করে তোলে। গণতন্ত্রের পথ ধরে কীভাবে চলতে হয়, তা-ই শিক্ষা দেয়। আজ যখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির পর্যালোচনা হয়, তখন বোদ্ধারা ঠিকই বলেন, রাজনীতির পথ বেয়ে উঠে আসা নেতা জাতীয় রাজনীতিতে কমে যাচ্ছে। ফলে অবক্ষয় বাড়ছে। যে ছেলেটি ছাত্র রাজনীতি করেছে, পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছে, সে স্বাভাবিকভাবেই তার দেশ ও দেশের সমস্যা-সম্ভাবনাকে ভালোভাবে অনুধাবন করবে। কিন্তু এ ধরণের মানুষের অভাবের কথাই বোদ্ধারা বলে থাকেন। আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, গণতন্ত্রের প্রথম ধাপের সবকটি দেয় ছাত্র রাজনীতি। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে তা দেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আরো শক্তিশালী করবে।
ঘ.সমসাময়িক সংকটে ভূমিকা পালন
রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িতরাই। এটাকে খারাপ হিসেবে দেখার কোন কারণ নেই। দেশে যে কোন সংকট তৈরি হলে ছাত্র রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা হয়তো টেবিল আলোচনায় সমাধানের পথ দেখান না, কিন্তু যে কোন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রাজপথে তারা সংগ্রাম করেন। অতীতে ছাত্র রাজনীতি কীভাবে সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছে, ইতোপূর্বে তা আলোচনা করা হয়েছে। দেশের চলমান সংকটেও ছাত্র রাজনীতি বড় ভূমিকা রাখছে। অপশাসন বিরোধী সংগ্রামে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ছাত্রজনতা রাজপথে সংগ্রাম চালিয়েই যাচ্ছে।
ঙ.আগামী নেতৃত্ব তৈরি
এই প্রয়োজনটি সকলেই ভালোভাবে অনুধাবন করেন। ছাত্র রাজনীতি করার মাধ্যমেই একজন ছাত্র নেতৃত্ব কী, জনগণের প্রত্যাশা কী, কীভাবে জনপ্রত্যাশা পূরণে ভূমিকা রাখতে হয়, তা শিখতে পারেন। এসব শেখার মধ্য দিয়েই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছাত্রটির মাঝে জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। কোন ব্যক্তি হঠাৎ করেই নেতা হয়ে যান না। কিংবা কেউ নেতা হয়েই জন্ম নেন না। নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবার আগে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়। ছাত্র রাজনীতি একজন ছাত্রকে তার গুনাবলি বিকশিত করার মাধ্যমে আগামী দিনের কারিগর হিসেবে তৈরি করে। কাজেই, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে দেশে ছাত্র রাজনীতি অব্যাহত থাকা জরুরী।

কারা ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়

দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন জনমনে একটা ধারণা জন্মেছে যে ভালো ছেলেরা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয় না। বাস্তবতা হলো, ছাত্র রাজনীতি কলুষযুক্ত হওয়ায় ভালো অনেকে চাইলেও কলুষমুক্ত থাকতে পারছে না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত- সব ধরণের পরিবার থেকেই একটা সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী রাজনীতিতে যুক্ত হন। একেক ধরণের অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে এসে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের চিন্তা ও কাজে পার্থক্য থাকে। একটু আলোকপাতের চেষ্টা করছি।
উচ্চবিত্ত: স্বাভাবিক ভাবে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের খুব বেশী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় না। যারা রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তারা পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রয়োজনে রাজনীতি করে। আর একটি অংশ করে শখের বশে। যেহেতু উচ্চবিত্ত হওয়ায় সম্পদের কোন অভাব নেই, তাই অর্থব্যয়ের একটা মাধ্যম হিসেবেও অনেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ছাত্র রাজনীতিতে এলে অবশ্য কম সময়ে নেতৃত্বে চলে আসারও সুযোগ পায়।
 মধ্যবিত্ত: মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই আর দশজনের মাঝে একটু মর্যাদার আসনে থাকার স্বপ্ন দেখে। একইভাবে স্বপ্ন দেখে অর্থশালী হওয়ার। আর এ কারণেই অনেকে রাজনীতিকে পাখির চোখ করে। দেখা যায়, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই রাজনীতিতে বেশী সক্রিয়। নিজেকে চূড়ান্ত উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা যে কোন বড় ভাইয়ের হাত ধরে শুরু করে। বড় ভাইয়ের সকল চাহিদা পূরণেও তারা সচেষ্ট থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই কোনটা নৈতিক কোনটা অনৈতিক সেটা বিবেচনায় নেয় না। কলুষযুক্ত ছাত্র নেতারা এর সুযোগ নেন। নতুন রাজনীতিতে আসা ছেলেমেয়েদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মেও এই ছেলেমেয়েদের ব্যবহার করা হয়। কমিটি গঠনকে সামনে রেখে কাউকে পোস্ট দেয়ার মুলো ঝুলিয়ে নানান অপকর্ম করিয়ে নেয়া হয়। এক সময়ে মধ্যবিত্ত ঘরের কেউ কেউ নেতা হবার সুযোগও পেয়ে যায়, কিন্তু তাদের নৈতিকতা বোধ ততদিনে চুলোয় ওঠে। দুঃখ হলো, যে নেতৃত্বের বেড়ে ওঠাই এভাবে, সেই নেতৃত্ব থেকে দেশ-জাতি খুব বেশী কী-ইবা  আশা করতে পারে?
ঠেকায় পড়ে রাজনীতি: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর হলে উঠতে হলে মোটামুটি কোন না কোন বড় ভাইয়ের হাত ধরেই উঠতে হয়। আর কেউ যদি নিজে নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলে উঠে, তাহলে তাকে প্রথম অথবা দ্বিতীয় রাতেই র‌্যাগের শিকার হতে হয়। এই র‌্যাগ সম্পর্কে আপনাদের সবার জানা আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এক নতুন ছাত্রকে র‌্যাগ দেয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হলে নতুন ওঠা এক ছেলেকে প্রথম রাতেই ৬/৭জন বড় ভাই তাদের রুমে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল করতে থাকে। ছেলেটিকে মদ পান করিয়ে এবনরমাল করে ফেলে। পরে তার সাথে সবাই একের পর এক জোর করে সমকামিতায় লিপ্ত হয়। ছেলেটি বুঝতে পারেনা কী করবে। সকাল বেলায় তার অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখে হল কতৃপক্ষ। ছেলেটি বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলে তার আর পড়ালেখা হয়ে উঠেনি। এ রকম বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে বড় ভাইদের গ্রুফের সদস্য হতে হয়। কাউকে আবার নির্যাতন না করে ধমক দিয়েই গ্রুফের মেম্বার করে নেয়। শুরু  হয় বড় ভাইদের কথা অনুযায়ী  নিয়মিত মিছিল মিটিংয়ে যাওয়া। এক পর্যায়ে কেউ কেউ ভাল ভাবেই শুরু করে, কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আবার কেউ নেতৃত্বে চলে যায়।
মূলত লেজুড়বৃত্তির কারণেই ছাত্রদের মাঝে আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে যায়। নিজেকে সবাই তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর তুলে ধরতে গিয়েই আতংক ছড়ানোর প্রয়োজন হয়। এটা অবশ্যই অস্ত্র ব্যতিত হয় না। অস্ত্রের ব্যবহার এখন রাজনীতির জন্য অনেকটা ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছে। গত নভেম্বর মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি স্বীকার করে নিয়েছেন যে তারা অস্ত্র ব্যবহার করেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে, আগের থেকে অস্ত্রের পরিমান কমানো হয়েছে। এর দ¦ারা বুঝা যায় পূর্বে আরো বেশী অস্ত্রের ব্যবহার ছিল। আর বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার, বিভিন্ন সময়ে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রকাশ এবং নিজেদের স্বীকারোক্তির পরও প্রশাসন তাদের গ্রেপ্তার করে না কারণ এ সকল ছাত্রনেতাদের তারা সরকারের অংশ মনে করে। ছাত্রনেতাদের কথায় অনেক সময় তাদের চাকরী, বদলি, প্রমোশন সুপারিশ এগুলো নির্ভর করে, সুতরাং ইচ্ছা করেই এমপি-মন্ত্রীর রোষানলে পড়ার কী দরকার? যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের অস্ত্র ব্যবহার জায়েজ হয়ে যায়।
এছাড়া আদর্শিক কারনেও অনেকে ছাত্ররাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে ।
                                                                                                         ...................  চলবে








                

প্রথম পর্বের লিংকঃ  http://monirahmedbd.blogspot.com/2014/12/blog-post.html

http://chhatrasangbadbd.com/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A7%9C%E0%A6%AC%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4/

বুধবার, ৪ মার্চ, ২০১৫

একজন শামীমের বাবা ও জনগণের অধিকার : মনির আহমেদ


শামীম (ছদ্মনাম), বয়স তখন সাত-আট বছর। গ্রামের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে প্রতিদিন সকালে মক্তবে যেত সে। মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে। একদিনের ঘটনা। সেদিনও সে মক্তবে গিয়েছিল। কিন্তু মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে যেতে পারলো না। পাড়ার সব ছেলে-মেয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলেও তার যাওয়ার উপায় নেই। কারণ তার বাবা অসুস্থ্য।
শামীম বুঝতে পারে তার বাবার অবস্থা বেশ খারাপ। ছোট্ট সে শুধু কাঁদতে থাকে।
বাবার কী হয়েছে? অনেক চিন্তা শামীমের মাথায় জটলা পাকায়। এ সময় চাচা-জ্যাঠাদের গর্জন শুনতে পায় সে। তারা বলাবলি করছে, আমাদের ডাকলিনা কেন? ‘কত বড় সাহস আমাদের বাড়ির সামনে এসে আমাদের ভাইকে এভাবে মেরে যাবে? এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
শামীম বুঝতে পারে কেউ তার বাবাকে মেরে আহত করেছে। খানিক পরেই সে মূল ঘটনা বুঝতে পারে।
শামীমদের বাড়ির পাশে ১২ শতকের একটি ভিটা আছে। তাদের গ্রামে বাড়ির পাশের উঁচু জমিকে ভিটা বলে। কিছু দিন থেকে এই ভিটা নিয়ে প্রায় সময় বাড়িতে তার বাবা বাসায় আম্মার সাথে কথা বলে। চাচা-জেঠাদের সাথেও বেশ ক’বার কথা বলেছে। এই ভিটা নিয়েই গ-গোল।
শামীমের দাদা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিল। বিভিন্ন সময় জমি বিক্রি করেছে মানুষের কাছে। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছে অথবা কাউকে এমনিতেই দলিল করে দিয়েছে। তার দাদা মানুষ হিসেবে অনেক উদার ছিল। সাধারন মানুষের কষ্ট একেবারেই সহ্য করতে পারত না। তাই সে মানুষের জন্য সাধ্যমত করতো। আর এই সুযোগ কিছু সুবিধাভোগী মানুষ কাজে লাগায়। কেউ হয়তো ১০ শতক নিয়েছে, কিন্তু ১৫ শতক ব্যবহার করা শুরু করতো। দাদার সরলতার সুযোগে এ কাজটি অনেকেই করেছে। পরবর্তীতে তার ছেলে মেয়েরা যখন বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে, তাদেরও সন্তানাদি হয়েছে; তখন জমির গুরুত্ব তাদের কাছে স্বাভাবিক ভাবে বাড়তে শুরু করেছে।
শামীমের বাবা ইতিমধ্যে বের করেছে যে ভিটাটি তাদের। তখন তার বাবা ভিটার মালিক ও গ্রামের মুরুব্বিদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে। মালিক পক্ষও ভিটা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় এবং বলে যে, ঠিক আছে আপনারা দখল নেন।
ঘটনার দিন সকাল বেলা শামীমের বাবা জমিটি দখলে নেয়। হাল চাষও শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে একজন ঝামেলা পাকায়। সে এতদিন যে ভিটাটি ভোগ করেছে, তাকে গিয়ে কুবুদ্ধি দেয়। সে বলে, কেন শামীমের বাবা এতদিন পরে ভিটাটি দখল করবে? শামীমের বাবাকে ভিটা দখলে নেয়া থেকে বিরত রাখতে সে পরামর্শ দেয়।
 কুবুদ্ধি ধরেই এতদিনের অবৈধ ভোগকারী লোকবল নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। শামীমের বাবা যখন ভিটায় হাল চাষ করতে যায়, তখন তার ওপর হামলে পড়ে। ফলে শামীমের বাবা গুরুতর আহত হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । 
ঘটনাটি এখানেই থেমে থাকে না। শামীমের বাবার বিরুদ্ধে সেদিনই মামলা করা হয়। দুপুর নাগাদ শামীমদের বাড়ীতে পুলিশ আসে। মামলাকারী প্রভাবশালী। তার বাপ-দাদারা দরিদ্র ছিল, কিন্তু সে নানাভাবে অর্থশালী হয়ে উঠেছে। কাজেই পুলিশ এসেছে। পুলিশের উপস্থিতি শামীমদের গ্রামে স্বাভাবিক নয়। পুলিশের খবর পেয়ে গ্রামের অনেক মানুষেরা জটলা পাকায়। সবার মাঝে এক ধরণের আতঙ্ক। পুলিশেরা শামীমের বাবার নাম করে গালাগালি করতে থাকে, জানান দেয় যে কাকে খুঁজতে এসেছে। শামীম হঠাৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করে বসে, আমার বাবাকে তোমাদের কী দরকার? শুনেই এক পুলিশ বন্দুকের নল দিয়ে শামীমের মাথায় মারে।
মুহুর্তেই গ্রামের মানুষেরা ভয়ে শামীমদের বাড়ি থেকে চলে যায়। এই অবস্থা শুনে হাসপাতাল থেকে শামীমের অসুস্থ্য বাবাই বাড়ীতে চলে আসে। বাড়ির লোককে শান্ত থাকতে বলে।
পরবর্তীতে শামীমের বাবাকেও বাড়ির লোকেরা মামলা করার পরামর্শ দেয়। ফলে মামলা দায়ের হয়। শুরু হয় মামলা পাল্টা মামলার খেলা। এই ভাবে চলে তিন বছর।
পরে মামলার রায় শামীমের বাবার পক্ষেই আসে। বিরোধী পক্ষ উচ্চ আদালতে আপিল করায় রায় স্থগিতও হয়।তারা যখন বুঝতে পারে যে মামলা চালিয়ে তাদের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখন তাদের পক্ষ থেকে শামীমের বাবার কাছে প্রস্তাব আসে, তারা আর মামলা চালাতে চায় না। গ্রামেই বিষয়টি সমাধান করতে চায়। শামীমের বাবা তা মেনে নেয়। গ্রামে সালিশ বসে। শামীমের বাবা ভিটা পান। পাশাপাশি মামলার পুরো খরচ। তাকে অসম্মান ও এতদিন অন্যায় ভাবে জমিন ভোগ করার জন্য জরিমানা স্বরুপ ভিটা ভোগকারী চার শতক অতিরিক্ত জমিন রেজিষ্ট্রি করে দেয়।
এবারে আসি দেশের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংযুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে পরপর তিনটি নির্বাচনও হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। কিন্তু জনগণ বারবার তত্ত্বাবধায়কের পক্ষেই দাবি তোলে। কিন্তু আওয়ামীলীগ জনগণ বা কোন রাজনৈতিক দলের কথায় কর্ণপাত করে না। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই ভোটার বিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, ৫% এর বেশি ভোটার উপস্থিত ছিল না। যদিও সরকার হিসাব দিয়েছে ৪০% ভোটের। অনেকে সংলাপের বিষয়ে তখন বললেও আওয়ামীলীগের বক্তব্য ছিল- আগে নির্বাচন হয়ে যাক, এরপর সংলাপ করে আবার নির্বাচন দেয়া যাবে। 
পরবর্তীতে বিরোধী দল ও জনগণ দেখলো আসলে আওয়মীলীগ ভোটের আগে সংলাপের বিষয়ে বললেও সরকার গঠনের পর তারা এই বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি নয়। অগত্যা দাবি আদায়ে এলো বিক্ষোভ সমাবেশ, হরতাল কর্মসূচী। এসবের পরও আওয়ামী সরকার কর্ণপাত করলো না। এবারে মাঠের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অবৈধ সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শন্তিপূর্ণ সমাবেশের আহ্বান করা হলো। এই সমাবেশ থেকেই সরকার পতনের জন্য চুড়ান্ত আন্দোলন ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু সরকার সমাবেশ হতে না দেয়ায় দেশে তীব্র সঙ্কট দেখা দিল। অবরুদ্ধ হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। লাগাতার অবরোধ চলতে থাকলো। দফায় দফায় হরতালও।
সরকার শুরু করলো গ্রপ্তার, নির্যাতন, ক্রসফায়ার। একদিকে হরতাল-অবরোধে দুষ্কৃতিকারীদের পেট্রোলবোমা, অন্যদিকে সরকারী বাহিনীর ক্রসফায়ার।
কারা মরছে? সাধারণ মানুষ। এই পর্যন্ত চলমান সঙ্কটে প্রায় শতাধিক মানুষের জীবন দিতে হলো। হাজারো গ্রেপ্তার, গুরুতর আহত শতাধিক মানুষ। বর্তমানে রাস্তায় মানুষ প্রতিবাদ করতে পারছেনা। রাস্তায় নামলেই পুলিশের গুলি। সরকারের কর্তাব্যক্তি আর প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের কথায় কোন তফাৎই নেই।  সবাই একই সুরে রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলছে।
প্রতিদিনই কোন না কোন মানুষের গাড়ি আগুনে জ্বলছে, কেউ না কেউ সন্তান, স্বামী হারাচ্ছে, ব্যবসা-বানিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপিদের কেউ বলছেন দেশে কোন অস্থিরতা নেই, আবার কেউ বলছেন দেশে অচলাবস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার আহ্বান জানাচ্ছেন শান্তিপূর্ন সমাধানের। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
এই যখন অবস্থা, তখন প্রতিবাদ জানাতে গুলশানে এসেছেন গাজীপুরের দেলোয়ার হোসেন নূর। তার কাছে কোন লাঠি, অস্ত্র বা নাশকতা চালানোর মত কিছু ছিল না। তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। প্রতিদিনই কোন না কোন সরকার সমর্থক গোষ্ঠি মানব বন্ধন, মিছিল অথবা খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করতে আসছে। এসবে কোন সমস্যাও নেই। অন্যদিকে নূর হোসেন একা প্রতিবাদ জানাতে এসেছে, এটাই সমস্যা! মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে শক্ত ভূমিকা পালনকারী বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মতিঝিলে অনশন করছেন অবরোধ তুলে নেয়া এবং সংলাপ-সমঝোতার জন্য, তিনিও একদিন নামায পড়ে এসে দেখেন তার বিছানাপত্র নেই। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, বিছানা-পত্র গুলো না নিলে কি হতো না? পরবর্তিতে কোন এক অশুভ ইশারায় তার কোন খবর এখন পত্রিকার পাতায় বা অন্যান্য গণমাধ্যমে দেখা যায় না।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন প্রতিবাদ করলে গ্রেপ্তার আর পুলিশের গুলি, ঠিক তখনই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের অধিবাসী জালাল উদ্দিন মজু (যিনি নিজেকে দার্শনিক ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেয়ারম্যান হিসাবে দাবি করেছেন)  গাছে উঠে অভিনব পন্থায় ২৪ ঘন্টার প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি দাবি করেন মাটিতে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে দেশের জনগণ। তাই তিনি ক্রসফায়ার, পেট্রোল বোমা, হরতাল, অবরোধের মত ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই কর্মসূচি পালন করেন। সকল পত্রিকায়, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তার খবর প্রচার করে। সরকারেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। গ্রেফতার করা হয় তাকেও। যেখানে তার কর্মসূচি শান্তির পক্ষে- কোন নাশকতা নেই, ভাংচুর নেই, জনগনের জান-মালের কোন ক্ষতি নেই; সেখানে কার স্বার্থে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো?
সরকার প্রধান কি ধরে নিয়েছেন হিটলার ,কর্নেল গাদ্দাফি ও সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও তিনি শক্তিধর?
যদি ধরে নিয়ে থাকেন তাহলে তাদের পরিণিতির কথা কি একবার ভেবে দেখা দরকার নয়?
আমার কাছে কেন জানি মনে হয় সেই কুবুদ্ধিদাতা যেমন শামীমের বাবার প্রতিপক্ষকে মামলায় নামিয়ে দিয়েছিল, এখনও সরকারের আশে-পাশে থাকা বাম ঘরনার ইনু-মেননরা কুপরামর্শ দিয়ে সমাধানের পথ থেকে আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে রেখেছে। একই ভাবে এটাও মনে হয়, শামীমের বাবাকে সম্মানহানি করার দায়ে প্রতিপক্ষকে যেমন জরিমানা দিতে হয়েছিল, তেমন জরিমানা এই সরকারকেও দিতে হবে। তবে আশংকা হলো, এখন যারা সমাধানের কথা বলছেন, আসলে তখন তারা এবং জনগণ (যাদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে) শুধু জরিমানায় রাজি হবেন কিনা?

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক



শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

শহীদ দিবসঃ আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাওয়াই হোক আমাদের প্রত্যয় - মনির আহমেদ



আগুনে গরম বালু। তার ওপর তাঁকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তিনি ছিলেন মৃতপ্রায়। কিন্তু মুখে ছিল সাহসের উচ্চারণ- আহাদ, আহাদ। তাঁর এই উচ্চারণে আবু জেহেল প্রচন্ড রেগে যায়। বর্শা নিক্ষেপ করে তাঁর লজ্জাস্থানে। তিনি শহীদ হন। হযরত সুমাইয়া (রা), তাঁকে আমরা চিনি ইসলামের প্রথম শহীদ হিসেবে।
হযরত সুমাইয়া (রা)র জীবনের শেষ সময়ের কথা চিন্তা করলে যে কারো হৃদয় কেঁপে উঠতে বাধ্য। কী ধরণের নির্যাতন সহ্য করেছিলেন তিনি! তবুও তিনি ইসলামের পথ থেকে এতটুকু সরে যাননি। ইসলামের পথে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে শহীদি মৃত্যুকে আপন করে নেয়ার এই ধারাবাহিকতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে। এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে।
এই ধারাবাহিকতায়ই আমরা পেয়েছি ১১ মার্চ। আজ যখন আমরা শহীদ সাব্বির, হামিদদের ওপার যাত্রার এ দিনকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি, তখন হৃদয়ে ভেসে ওঠে দূরের বা কাছের অতীতের আরো অসংখ্য শাহাদাতের ঘটনা। আমরা অনুপ্রাণিত হই, আবার প্রিয় ভাইয়ের পবিত্র মুখ, জীবন স্মৃতি আমাদের চোখে পানি আনে।
প্রিয় নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার কথা আমাদের মনে পড়ে। অকুতোভয় এই মানুষ নিজেই ফাঁসির রশি গলায় জড়িয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘকায় ছিলেন না। কিন্তু রাব্বুল আলামীন যে তাঁকে কতটা উচ্চতায় স্থান দিয়েছেন, তা আমরা ঠিকই বুঝতে পারি।
মাওলানা মওদুদী (র)কে যখন ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা চলছিল, তখন তিনি যে কথা বলেছিলেন, আজ তা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মুখে মুখে ফেরে। ‘মৃত্যুর ফয়সালা আসমান থেকে হয়, যমীন থেকে নয়।’ এই বিশ্বাস শতভাগ আছে বলেই আজো ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা কোন দ্বিধা ছাড়া মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।
মুতার যুদ্ধে যেখানে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার, সেখানে শত্রু পক্ষের ছিল লাখো সেনা সমাবেশ। রাসূল (সা) সে সময় যায়িদ বিন হারিসা (রা)কে সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। রাসূল (সা) বলেন, যায়িদ শহীদ হলে জাফর বিন আবু তালেব (রা) সেনাপতি হবেন। আরো বলেন, জাফর শহীদ হলে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা) সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা শহীদ হলে নিজেদেরকে সেনাপতি ঠিক করে নেয়ার নির্দেশ দেন।
রাসূল (সা) এর তিনজনের নাম উল্লেখ করা অনেকের কাছে তাঁদের শাহাদাতের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। কিন্তু এই তিন সাহাবীসহ কেউই একটুও পিছু হটেননি। তিন সাহাবীই যুদ্ধের ময়দানে একে একে শহীদি পেয়ালা পান করেছেন। তাঁরা প্রমান করেছেন, যারা মহান রবের বানী বুঝেছে, তাঁরা শহীদি মৃত্যুকে বড় পুরস্কার হিসেবেই মনে করেন।
স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে মেধাবী ছাত্র নেতা আব্দুল মালেকের শাহাদাত প্রমান করে, আজ ছাত্রশিবিরের সাথে বিরুদ্ধ শক্তির যে শত্রুতা তা এই সংগঠনের বর্তমান কোন অবস্থানের জন্য নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব জায়গায়ই ইসলামী আন্দোলনের পথে বাধা দেয়া হয়েছে। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা বারবার পবিত্র সব শরীরে বন্দুকের গুলি চালিয়েছে, ধারালো ছুরি চালিয়েছে।
শহীদ আব্দুল মালেক তাঁর চিঠিতে, লেখায় শাহাদাতের আকাংখার কথা বারবার জানান দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সূর্যোদয় হবার আগেই শহীদি ধারাবাহিকতায় যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন, তা স্বাধীন বাংলাদেশেও ইসলামী আন্দোলনকে মজুবত একটি ভিত্তি দিয়েছে। মালেক ভাইয়ের খুনের কলুষযুক্ত তোফায়েল আহমেদরা আজো যেমন ক্ষমতায় থেকে বন্দুকের নল তাক করছে, আজো প্রিয় শহীদের উত্তরসূরীরা প্রতিরোধের প্রাচিরকে নিশ্চিদ্র রাখতে নিজের বুকে গুলিকে ধারণ করছে।
উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা শহীদি পেয়ালা পানের উজ্জল সব নমুনা দেখতে পাই। শহীদ তিতুমীর বাঁশের কেল্লা গড়ে যেভাবে দখলদার অপশাসক বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে শহীদ হয়েছেন, তা আজো ছাত্রজনতাকে আন্দোলনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে উ’সাহিত করে। ছাত্রজনতা আজ ভার্চুয়াল বাঁশেরকেল্লার মত বিকল্প গণমাধ্যম তৈরি করে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে বিরামহীন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
মিশরের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস পৃথিবীর যে কোন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর কাছে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। ইমাম হাসান আল বান্না, সাইয়েদ কুতুবদের অসাধারণ জীবন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করে। সাইয়েদ কুতুবের প্রথম কারাদন্ড হয়ে এক বছর জেলে থাকার পর কর্নেল নাসের সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল তিনি যদি পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান তাহলে তাকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে  । মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে জবাব দিয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে । তিনি বলেন ,আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চার্যান্বিত হচ্ছি যে, মজলুমকে জালিমের নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে   বলা হচ্ছে । আল্লাহর কসম ! যদি ক্ষমা পার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে ,তবুও আমি এরুপ শব্দ উচ্চারন করতে রাজি নই । আমি আল্লাহর দরবাদের এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে,আমি তার প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।  আজ যখন প্রিয় বোন আসমা বেলতাগি রাজপথে আন্দোলনে থেকে শহীদ হন, তখন ইসলামী আন্দোলনের পথচলায় শাহাদাতের প্রয়োজনীয়তা আরো সুস্পষ্ট হয়।
পৃথিবীর নানা প্রান্তেই মানুষ মহান রবের বাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে শাহাদাতের পথ ধরে এগিয়েছে। নানা প্রান্তের মানুষ দখলদার জালিম শাসকদের মোকাবেলায় নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী আন্দোলন হামাসের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে শাহাদাতের উদাহরণ তৈরি করে চলছেন। শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিসির পথ ধরে মুক্ত আল আকসার আশায় আজো নিজেদের জীবনকে বাজি রাখছেন।
আমরা ভুলতে পারি না মুক্তির আশায় সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া কাশ্মিরের মুসলমানদের কথা। তেমনিভাবেই জানি চেচনিয়ার বিপ্লবীদের কথা। চীনের প্রাচিরের আড়ালে কত উইঘুর মুসলিম যে শহীদ হচ্ছেন, তা প্রচারের আলোয় তেমনভাবে আসেই না। কিন্তু কোন জায়গায়ই মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি। ইসলামের পাতাকাবাহী যুবকেরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে আজ আরো সুসংহত।
ফিরে আসি ১১ মার্চের কথায়। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চে মতিহারের সবুজ চত্ত্বরে আমরা হিং¯্র হায়েনাদের নিরীহ শিবির নেতাকর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি। শাহাদাতের পেয়ালা পানের মাধ্যমে এই পবিত্র সংগঠনের শহীদি খাতায় প্রথম নাম লেখান মোহাম্মদ সাব্বির হোসাঈন। লোহার রড, পাইপ গান, দা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। জাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রীর সন্ত্রাসীরা একটা ইটের ওপর আব্দুল হামিদের মাথা রেখে আরেক ইট দিয়ে থেতলে দেয়। শহীদ হন আব্দুল জব্বার ও আইয়ুবও।
পরবর্তী সময় থেকে ছাত্রশিবির ১১ মার্চকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। শহীদ সাব্বির, হামিদের পথ ধরে আরো শতাধিক ভাই নিজেদের আল্লাহর পথে সপে দিয়েছেন। আমরা পল্টনের রাজপথে ২৮ অক্টোবরে মুজাহিদ, শিপনদের শাহাদাত দেখেছি। ইসলামী আন্দোলনকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে তাঁরা কীভাবে বাতিলের মোকাবেলা করে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, তা আজো রাজধানীর ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের স্মৃতিতে ভাস্বর।
পরবর্তী সময়ে ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার সরকারী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ছাত্ররা জীবন দিয়েই চলছে। তবুও কুরআনের খাদেমদের কারামুক্ত করার আকাংখা ছাত্রজনতার হৃদয় থেকে মুছে যায়নি।
রাসুল (সা) এর আগমনের পূর্বেও মানুষকে সত্যের দাওয়াত দিতে গিয়ে নবী-রাসুল ও তাদের অনুসারীরা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক নবীর অনুসারীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। হযরত মুসা (আ), ইসা (আ)সহ অনেক নবীকে দীর্ঘদিন নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। তারপরও সে সময় আল্লাহর পছন্দনীয় এই মানুষেরা ধৈর্য্যধারণ করেছেন এবং মানুষকে সত্যের পথে ডেকেই গেছেন।
আজ মুসলিম বিশ্বকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে পশ্চিমা শক্তি মুসলমানদের হত্যা করছে। যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায়। এসব দেশে ইসলামপ্রিয় মানুষেরা কুরআনের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হোক তা চাইলেও তাদের সে আশাকে চক্রান্তের জালে আটকে রাখা হচ্ছে। উল্টো যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে এসব দেশের ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলা হচ্ছে। তদুপরি এসব দেশেও ইসলামপ্রিয় মানুষেরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে একদিন এসব দেশে কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠিত হোক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা শাহাদাতের পূর্ব সময়ে বলে গেছেন যে তাঁর রক্ত যেন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজে লাগায়। কোন ধরণের প্রতিশোধপ্রবন মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তাঁর এই আহ্বান শহীদ ভাইদের স্বচ্ছ হৃদয়কেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে শহীদ ভাইদের প্রতি ফোটা রক্তের বদলা হিসেবে আমরা অন্য কারোর রক্ত নিতে চাই না। কারোর চুল পরিমান ক্ষতি হোক তা চাই না। কিন্তু দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকেও একচুল পরিমান সরে যেতে চাই না। আমাদের প্রতিশোধ হবে বাংলাদেশের সবুজ যমীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা।
শহীদ সাব্বির ছাত্রশিবিরের হয়ে যে মিছিল শুরু করেছেন, সে মিছিলে আজ শত শত পবিত্র মুখের সমাহার। তাঁরা আমাদের ডাকছে। অটল থাকতে বলছে। অবিচল পথ চলতে বলছে। শহীদ দিবসে শাহাদাতের চিন্তাকে হৃদয়ে যতেœর সাথে লালন করে সচেতনভাবে ইসলামী আন্দোলনের এই পথে এগিয়ে যাওয়াই হোক আমাদের প্রত্যয়। 








রবিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৫

একুশের ধারাবাহিকতায় ছাত্রসমাজ : মনির আহমেদ




একে তো ভাষার জন্য এমন আন্দোলনের নমুনা পৃথিবীর কোথাও নেই, তার ওপর অধিকার আদায়ের দাবিতে ছাত্রজনতার অনন্য প্রতিবাদ; এই দুইয়ের সমন্বয় ৫২র ভাষা আন্দোলনকে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছে। আর ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা‘ গেয়ে স্বাধীকার আন্দোলনের এক চিরন্তন সবক এ দেশের মানুষ এই মহান আন্দোলন থেকেই পেয়েছে। কাজেই, আজো যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলতে গেলে আমাদের বারবার একুশের দিকে তাকাতে হয়।
ভাষা আন্দোলন মুখ্যত ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জি.এস অধ্যাপক গোলাম আজম বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে প্রথম স্বারকলিপি প্রদান করেন । পরবর্তীতে  সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, ভাষা সৈনিক আব্দুল গফুররা বলিষ্ঠভাবেই সে সময় ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেদের দায়িত্বের আঞ্জাম দিয়েছেন। তারা আমাদের সবক দিয়ে গেছেন কী করে রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে মায়ের ভাষাকে বুকে আগলে রাখতে হয়। সালাম,জব্বর,রফিক,বরকতেরা শিখিয়েছেন কিভাবে ন্যায্য দাবিকে ঘিরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষে নিয়ে যেতে হয়।
৫২র পর থেকে অধিকার আদায়ের চেতনা যেন ছাত্রজনতার রক্তে মিশে গেছে। যার ফলে পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজকে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। যদিও বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে ব্যক্তি স্বার্থের কলুষ যুক্ত হয়েছে, কিন্তু ভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তি  গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনের অধ্যায়ে ব্যক্তি স্বার্থ চিন্তা কারোর মাথায় এসেছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। যদিও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আজ নানান বিতর্ক, কিন্তু এই স্বপ্নও অনেক মানুষ দেখেন যে গণতন্ত্র রক্ষা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্ররাই নেতৃত্ব দিয়ে যাবে।
একুশের আন্দোলনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সে সময় ছাত্ররা সাহস করে সত্য বলার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানি শাষকদের নির্যাতন, প্রলোভন কোন কিছুই ছাত্র নেতাদের আন্দোলনের চলমান পথ থেকে একচুল বিচ্যুত করতে পারেনি। ফলে রাজপথ বুকের রক্তে ভেসে গেলেও, চলে যায়নি মুখের সাহসী উচ্চারণ।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতা পরবর্তীতেও আমরা পরিস্কার দেখতে পাই। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র সমাজ অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল। ছাত্রনেতা আসাদ (শহীদ আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান) আজো গণতান্ত্রিক যে কোন আন্দোলনের প্রেরণা। আইয়ুবশাহীর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাঁর জীবন দান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই স্থান পেয়েছে। শুধু ছাত্রনেতা আসাদ নয়, আইয়ুবশাহীর পতন ঘটাতে সে সময় সাধারণ ছাত্ররা যেভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল, তা সত্যিই বিষ্ময়কর। এমনকি দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরও বুক পকেটে মা‘কে লেখা চিরকুট নিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। তাঁর মৃত্যু বাংলার আপামর জনসাধারণকে যেমন কাঁদিয়েছিল, তেমনি মানুষকে নতুন করে আন্দোলনের শপথে বলীয়ান করেছিল।
জাতীয় নেতাদের অনেককেই আইয়ুব সরকার কারাবন্দী করে রেখেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকেনি। ছাত্রনেতারা সামনে থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রকামী মানুষেরা ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল। মানুষের মনে সে সময় এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবেই ছিল যে ছাত্ররা আন্দোলন করছে মানে সে আন্দোলনের শতভাগ যৌক্তিকতা রয়েছে। কাজেই, আপামর জনসাধারণ আন্দোলনে অংশ নিতে কোন কুণ্ঠা বোধ করেনি। আর সেজন্যই আমরা গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের তালিকায় গৃহবধু, কৃষক, শ্রমিকসহ নানান পেশার মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাই।
আমরা যদি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের আগের ইতিহাসের দিকেও তাকাই, তাহলেও ছাত্র সমাজের গৌরবোজ্জল ভূমিকা দেখতে পাব। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ৬২র শিক্ষা আন্দোলনেও ছাত্র সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের অবদানের কথা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হবার আগ থেকেই সচেতন ছাত্রসমাজ স্বাধীনতার জন্য কাজ করে আসছিল। সে সময়ের ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রবদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি আ স ম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তলন উদ্বোধন করেন। শ্লোগানে-মিছিলে আওয়াজ তুলে ছাত্রসমাজই সারাদেশে মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাগরণ তৈরি করেছিল।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে জাতীয় নেতাদের পথচলার পেছনে আমরা ছাত্রনেতাদের স্পষ্ট ভূমিকা দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধের সসস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রসমাজ কৃষক, শ্রমিক, মজুরদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে, তখন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, তা সসস্ত্র সংগ্রামকে আরো বেগবান করেছিল। যুদ্ধের নয় মাসে ছাত্রসমাজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে থেকে বাংলার মানুষকে সাহস যুগিয়েছে, সব বাধা মোকাবেলা করে বিজয়ের কাঙ্খিত লক্ষে পৌছানোর স্বপ্নে মানুষকে বিভোর রেখেছে।
১৯৯০ স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যে সফলতার মুখ দেখেছিল, এর পেছনে ছাত্রসমাজের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে। ৮২ সালে সামরিক বাহিনী থেকে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ছাত্রসমাজ গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে রাজপথে সোচ্চার ছিল। এরশাদ রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক ছাত্র হত্যা চালিয়ে যায়। ১৯৯০ এর অক্টোবর মাসে যখন ছাত্রনেতা নাজিমউদ্দিন জেহাদ শহীদ হন, তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে উঠেছিল। এরপর থেকেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সাফল্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। ডা. মিলনসহ বেশ ক‘জনের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। মূলত, ১৯৯০সালের ১০ অক্টোবর গড়ে উঠা ছাত্র আন্দোলনের সফলতাই বাংলাদেশকে তখন স্বৈরাচার মুক্ত করে।
কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ছাত্রজনতা অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। একদিকে এই সরকার ব্যবস্থার রুপকার অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াত-শিবির যেমন এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বের আন্দোলনেও ছাত্ররা ভূমিকা রাখে। যার ফলে আমরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে তত্তাবধায়ক সরকারের এক সুন্দর ব্যবস্থা পাই। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
পরবর্তীতেও আমরা ছাত্রসমাজের কিছু ভূমিকা দেখেছি। কিন্তু অতীতের তুলনায় তা ছিল অনুজ্জল। ছাত্র সংগঠনগুলো হারিয়েছে স্বকীয়তা, লেজুড়বৃত্তিতে ছাত্র রাজনীতি আজ কলুষিত হয়ে পড়েছে। ভাষা আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পরবর্তীতে, আজ তা মনে করে আমাদের আফসোস করতে হয়।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জামায়াত ইসলামীর সমাবেশ সমাবেশ পন্ড করতে এসে পল্টন মোড়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা যখন জামায়াত-শিবিরের নিরীহ নেতাকর্মীদের ওপর অস্ত্রসহ হামলা চালিয়েছিল, তখনও কিন্তু আমরা এক ঝলক একুশের ধারাবাহিকতা দেখতে পেয়েছি। শহীদ মুজাহিদ, শিপনরা সেদিন জীবন দিয়ে সন্ত্রাসীদের কালো থাবা কী করে প্রতিরোধ করতে হয় তার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখে গেছেন।
যখন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বিচারিক হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তখন থেকে বাংলাদেশে আমরা ছাত্রজনতার গণজাগরণ দেখতে পেয়েছি। আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে দেয়া সাজানো রায়ের পর ছাত্রজনতা সারা বাংলাদেশে যে আন্দোলনের নমুনা পেশ করেছে, তাও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শতাধিক ছাত্রজনতা একই দিনে অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে যেভাবে নিজেদের জীবন দিয়েছে, তা পাঠ করে ভবিষ্যতের ছাত্রজনতা আত্মত্যাগের প্রেরণা খুঁজে পাবে।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় যেমন দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর শহীদ হয়েছে, তেমনি ভাবে ৩ ডিসেম্বর ২০১২ সাম্প্রতিক সময়ে দিনাজপুরে দশম শ্রেণীর ছাত্র মুজাহিদ শহীদ হয়েছে। আমার বিশ্বাস, ইতিহাসবীদদের সত্য লেখনিতে একদিন মুজাহিদের নামও মতিউরের মত উজ্জল হয়ে উঠবে।
৯১ সালের পর থেকে আমরা একের পর এক গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে পেলেও দু:খজনকভাবে কোন সরকারই ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের ধারাাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়ক হয়ে ওঠেনি। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রয়েছে। ফলে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে সঠিক ব্যক্তি উঠে আসছে না। আর সেজন্যই আমরা দেখছি সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজ পরবর্তীতে আন্দোলনের যে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, তা থেকেই বর্তমানে আমাদের প্রেরণা নিতে হবে। প্রতিটি আন্দোলন থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছুই রয়েছে। কী করে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে ভয়হীন হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়, কী করে আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে একত্রিত করতে হয়, এসব আমরা একুশ ও পরবর্তী আন্দোলনগুলো থেকে শিখতে পারি।
ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের পাঠ আমাদেরকে বলে, একুশের সংগ্রামীরা যুগের পর যুগ মানুষের জয়গান গেয়ে গেছে। একুশ যে ছাত্রসমাজের মাঝে যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে, তা আজো সাধারণ ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে আছে। কাজেই, বর্তমানের আওয়ামী অপশাসন বিরোধী আন্দোলনে আমাদের একুশের প্রেরণা নিয়েই ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। কোন আন্দোলনই গাছ থেকে পাকা ফল পাওয়ার মত সহজ নয়। আন্দোলনের পথে অনেক বাধা আসে, সব মাড়িয়েই ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যেতে পারলে একদিন সফলতার দেখা মেলে।
আজ শাসকের নামে যারা শোষক হয়ে বসে আছে, গণতন্ত্র হরণ করে বাকশাল কায়েমের পায়তারা করছে, তাদেরও একুশ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শোষণ করে ক্ষমতায় টেকা যায় না, এ সত্য ইতিহাসের পাতায় স্পষ্ট প্রতীয়মান। এভাবে শোষণের পথ ধরে হাঁটতে থাকলে শুধু আওয়ামীলীগ নয়, যে কোন শাসকেরই পতন অবধারিত।
সবশেষে বলতে চাই, একুশ থেকেই আমরা জানি- ছাত্রজনতা সবই পারে। আজকের জালিম শাসক যদি স্বেচ্ছায় মসনদ থেকে সরে না দাঁড়ায়, তাহলে আগামী দিনে ছাত্রজনতা তাদেরকে চরম শিক্ষা দেবে। শুধু সময়ের ব্যাপার, ছাত্রজনতার জয় হবেই ইনশাআল্লাহ।