মনির আহমেদ
শাহাদাত হোসেন। কুমিল্লার মুরাদ নগরে ছেলেটির বাড়ি। জন্ম থেকেই সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ছোটকাল থেকেই পড়াশুনায় তার আগ্রহ। এই আগ্রহই তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। প্রতিবন্ধকতা জয় করে জিপিএ ৫ সহ কৃতিত্বের সাথে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে শাহাদাত।
২০১১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়ার পর আমার সাথে শাহাদাতের পরিচয়। শাহাদাতের ওরই মতো আরো ক’জন বন্ধু আছে। একদিন তাদেরকে নিয়ে বসলাম।
হাসান নামের একজন বলছিল, ‘মনির ভাই আমরা অনেক বড় হতে চাই। মানুষের মত মানুষ হতে চাই। দেশের জন্য কিছু করতে চাই ,আমাদের কেউ গুরুত্ব দিতে চায় না। আমাদের পরিবারের নিয়মিত সহযোগিতা করার মত কোন অবস্থা নেই। আপনারা যদি আমাদের সহযোগিতা করেন, তাহলে আমরা সাহস হারাবো না। এগিয়ে যেতে পারবো।’
শাহাদাত আরো বললো, ‘ভাই আমাদের টেপ রেকর্ডার দরকার। টেপ রেকর্ডার হলে শুনে মখস্ত করতে সুবিধা হয়।’
কলেজের ছোট ভাই হাবিবকে একটি টেপ রেকর্ডার কিনে দিতে বললাম। তাদের কথা শুনতে শুনতে হৃদয়ে আবেগর ঝড় অনুভব করছিলাম। তাদের সবাইকে সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করলাম, যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সেটা ছিল খুবই সামান্য। শাহাদাত ও হাসান দুজনই এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। আমি আশা করি তারা আরো ভালো করবে। এই শাহাদাত ও হাসানের মত তরুণেরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে চায় না, তারা নিজেদেরকে সম্পদে পরিণত করতে চায়।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করে এ কথাই আরো জোর দিয়ে জানান দিল শাহাদাত ও হাসানের উত্তরসূরী অদম্য মেধাবী প্রতিবন্ধীরা। নিজেদের শারিরিক প্রতিবন্ধকতার কথা ভুলে ওরা যারপরনাই চেষ্টা করেছে মেধার যুদ্ধে টিকে থাকতে। কেউবা অন্যের জমিতে কামলা খেটে পরীক্ষা দিয়েছে, কেউবা পড়ালেখার খরচ জোগাতে চালিয়েছে রিক্সা, আবার কারো বাবা-মা অন্যের ঘরে কাজ করে সন্তানের পরীক্ষার ফি দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এভাবে নানা দিক থেকে তারা ছিল সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত। অথচ কোন রকম পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেয়ে তারাই কিনা সবাইকে তাক লাগিয়ে বাজিমাত করেছে। কেউ পেয়েছে এ প্লাস, কেউ অর্জন করেছে গোল্ডেন এ প্লাসের গৌরব।
আমরা আশা করেছিলাম এসব মেধাবীদের ভরণ-পোষণ বা দেখভালের দায়িত্ব নেবে সরকার। কিন্তু দূর্নীতি-দুঃশাসনে সরকার সবার থেকে এগিয়ে থাকলেও এই অসহায় মানুষের সহযোগিতার ক্ষেত্রে আছে সবচেয়ে পিছিয়ে। দেশের কোটি কোটি টাকা লুট করেও তাদের সামর্থ্য হয়নি কয়েকজন মেধাবী প্রতিবন্ধীর মুখে হাসি ফোটাবার।
এলাকা ভিত্তিক কিছু সামাজিক সংগঠন জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংবর্ধনা দিলেও অদম্য মেধাবীদের আলাদা করে খবর তেমন কেউ নেননি।
শুধু একটি সংগঠন অদম্য মেধাবিদের জন্য আয়োজন করেছে সংবর্ধনার। এই সংগঠনটি প্রত্রিকায় প্রকাশিত সকল অদম্য মেধাবীকেই সংবর্ধনা দিয়েছে। বিভাগ ভিত্তিক চারটি অনুষ্ঠান করে মোট ১৪৬ জন অদম্য মেধাবীকে ক্রেষ্ট, একাডেমিক বই ও নগদ ৫০০০ টাকা করে সহায়তা প্রধান করে।
এই সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা প্রোগ্রামগুলোয় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুল জাব্বার ও সেক্রেটারী জেনারেল আতিকুর রহমান। উপস্থিত ছাত্ররা যতদিন পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চায়, ততদিন ছাত্রশিবির তাদের পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ আয়োজিত সংবর্ধনায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধি সুমাইয়া আক্তার ও মাহমুদা আক্তার এসেছিল নীলফামারী থেকে। সুমাইয়া সংবর্ধনায় বক্তব্য রাখে। সে ছাত্রশিবিরের উদ্যোগরে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তার বক্তব্যে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। এমনিতেই সে অন্ধ। মা নেই, বাবা বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ্য, মাঝে মাঝে রিক্সা চালান। বয়োবৃদ্ধ বাবা যা আয় করেন, তা দিইে চলতে হয়। এমন অনেক দিন গেছে যে না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে সুমাইয়াকে। এরপরও পড়াশুনার আগ্রহের জায়গা থেকে সে একচুলও নড়েনি। তার আগ্রহই তাকে জিপিএ ৫ পেতে সহযোগিতা করেছে।
আর একজন মাহমুদা। বাবা নেই, মাকে নিয়ে এসেছিল সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ছাত্রশিবিরের কাছে তারা সহযোগিতা চায়। নেতৃবৃন্দ তাদের আশ্বস্ত করেন। জানান, সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করতে ছাত্রশিবির প্রস্তুত ।
আমাকে এ বিষয়ে আরো অনেক তথ্য জানিয়েছেন শিবিরেরর কেন্দ্রীয় স্কুল সম্পাদক মো: শাহীন আহমেদ খান। তাঁর তত্ত্বাবধানেই এই সংবর্ধনাগুলো অনুুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শিবির সভাপতি এ সকল প্রোগ্রামে সমাজের বিত্তবানদেরএই বলে আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা প্রতিবন্ধীদের সমাজের বোঝা মরে না করে। প্রত্যেকে যেন সাধ্য অনুযায়ী সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং এইসব অদম্য মেধাবীদের সুন্দর ভবিষ্যত গঠনে সহযোগিতা করেন ।
ছাত্রশিবিরের এ সকল অনুষ্ঠানে শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দরাও মেহমান হিসাবে উপস্থিত থেকে সবসময় ছাত্রদের পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অদম্য মেধাবী সংবর্ধনার বিষয়ে শিবির সভাপতির বক্তব্য হলো, ‘এই সংগঠন সবসময় ছাত্রদের কল্যানে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে। এ ধরণের আয়োজন ছাত্রদের পাশে থাকার একটি অংশ। দেশের সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক সমাজ, বিশিষ্টজনরা জানেন আমাদের প্রকাশ্যে কোন কার্যক্রম পরিচালিত করতে দেয়া হচ্ছে না, এমনকি বিভিন্ন জেলায় আমরা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলাম তাও আমরা প্রকাশ্যে করতে পারিনি। তবে, প্রশাসন ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের শত বাধা, হামলাসহ নানা বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও আমরা থেমে যাইনি। আর সব কার্যক্রমের মতো আমরা সংবর্ধনা, সেবা ও কল্যাণমুলক কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও অদম্য মেধাবীদের সংবর্ধনা দিয়েছি। সাধারণ মেধাবীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেছি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশগঠনে মনোযোগী হতে। তেমনিভাবেক অসহায় প্রতিবন্ধী মেধাবীদের আমাদের সাধ্য অনুযায়ী আর্থিক অনুদানও দিয়ছি। তাদের পড়া-লেখার যাবতীয় ব্যয়ভারও বহনের ঘোষনা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সমাজের মানুষের কাছে দোয়া চাই যেন সকল যুলুম নির্যাতন উপেক্ষা করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ রাসুল (সঃ) এর আদর্শ বাস্তবায়নে ভুমিকা রাখতে পারি । ছাত্রসমাজসহ সাধারন মানুষের পাশে সবসময় থাকতে পারি।
আমরাও চাই শুধু ছাত্রশিবির নয়, সরকার, সমাজের প্রত্যেক বিত্তবান মানুষ ও সামাজিক সংগঠন প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসুক অদম্য মেধাবীদের সহযোগিতায়। তাদেরও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। তারা দেশের বোঝা নয়, পরিণত হোক সম্পদে। এগিয়ে যাক দেশ এবং জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখার জায়গায়। দূর্নীতি ও শোষন মুক্ত সমাজ গঠনে তারাও ভূমিকা রাখুক, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও লেখক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন