মনির আহমেদ
আইনজীবিরা বিভেদ দূরে ঠেলে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার ছিলেন যেন বিলটি পাশ না হয়। সোচ্চার ছিলেন পেশাজীবিরা, দেশের সচেতন মানুষেরা। কিন্তু কাউকে তোয়াক্কা করেনি বর্তমান আওয়ামী সরকার। কার্যত একদলীয় সংসদে পাশ হলো বিলটি।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিলটি উপস্থিত সাংসদদের ৩২৭ ভোট পেয়ে সর্বসম্মত ভাবে পাস হয়। স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে দিনের অন্যান্য কার্যসূচি স্থগিত করে বিল পাসের কার্যক্রম শুরু হয়। বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক। বিলটির ওপর বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পাটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ জাতীয় পার্টি, সরকারের শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বিএনএফ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ মোট ১৫ জন জনমত যাচাই-বাছাই এবং ৩০টি সংশোধনী প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও পরে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সদস্যরা বিলের পক্ষে অবস্থান নিলেও তড়িঘড়ি করে গুরত্বপূর্ণ এই বিল পাসের সমালোচনা করেন। তারা সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা ও জনমত যাচাইয়ের পর বিলটি পাসের দাবি উত্থাপন করেন। নানা ইস্যুতে পার্টির অভ্যন্তরে বিরোধ থাকলেও বিলের ওপর আলোচনায় তারা একই সুরে কথা বলেন। পরে সংসদের লবিতে স্থাপিত বুথে গোপন ব্যালটে বিভক্তি ভোটে বিলটি পাস হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা আলোচনা শেষে রাত ১০টা ১০ মিনিট থেকে ভোট দেয়া শুরু হয়। ৪০ মিনিটে ভোট দেয়ার কাজ শেষ হয়। পরে ভোট গণনা শেষে স্পিকার ফল ঘোষণা করেন। এ সময় টেবিল চাপড়ে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা অভিনন্দন জানান।
এই বিলটি পাস হওয়ায় ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপিত হবে। ওই অনুচ্ছেদে কোন বিচারককে তার বিরুদ্ধে প্রমানিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল। তবে এই অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বর্তমান বিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর বহাল রাখা হয়েছে।
আমি ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার প্রত্রিকাগুলো খুব মনোযোগসহ পড়ছিলাম। কারণ এই দিনের পত্রিকাগুলো ২টি কারনে গুরুত্বপূর্ন ছিল। এক, সংবিধান সংশোধন; দুই, মাওলানা সাঈদীর রায়। অনেকে মনে করেন ষড়োশ সংশোধনী নিয়ে কোন ধরনের আন্দোলন যেন হতে না পারে সেজন্যই মাওলানা সাঈদীর রায়ের দিনটিই তাই বেছে নেয়া হয়েছে। দেখা গিয়েছে, সাইদী সাহেবের রায় পরবর্তী বিক্ষোভ-হরতালে এই বিল পাশ তাই তেমনভাবে প্রচারের আলোয় আসেনি।
গত ৭ সেপ্টেম্বর আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক সংসদে বিলটি উত্থাপনের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ওই দিনই তা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। শুরু হয় সমাজের বিশিষ্টজন, আইনজীবি, রাজনীতিবিদদের প্রতিবাদ, বিরোধীতা। এই বিরোধীতা অন্যান্য সময়ের মত শুধু একপেশে বিরোধীতা ছিলনা। প্রতিবাদ শুরু করেন আওয়ামী ঘরণার লোকেরাও।
বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর প্রথমেই সাংবাদিকরা সংসদীয় বিরোধীদলের কাছে না গিয়ে রাজনৈতিক বিরোধী দল হিসাবে যারা পরিচিত বিএনপি নেতৃবৃন্দের বক্তব্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সংসদীয় বিরোধী দলকে দেশের বড় অংশের মানুষ যে গৃহপালিত বিরোধীদল মনে করেন, এটা তাই প্রমান করে। শুধু তাই নয়, স্বয়ং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হোসাইন মো: এরশাদও ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন, যদি পক্ষে বলি তাহলে তো গৃহপালিত হয়ে যাব। তার বক্তব্য শুনে উপস্থিত সাংসদরা উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়েন।
বলছিলাম, সাংবাদিকরা রাজনৈতিক বিরোধী দলের মতামত তুলে ধরেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা বর্তমান ‘অবৈধ’ সংসদের নেই দাবি করে বিলটি পাস হলে আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দেন বিএনপি নেতারা। পরবর্তিতে ২০ দল দুই দিনের কর্মসূচিও পালন করে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা বর্তমান অবৈধ সংসদের নেই। যে সংসদে জনগণের প্রতিনিধি নেই, ১৫৪ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সেই সংসদের হাতে বিচারপতিদের অভিশংসন ক্ষমতা দিচ্ছে সরকার। এই ক্ষমতা বর্তমান সংসদের হাতে গেলে জনগণ ন্যায়বিচার পাবে না। শুধু একটি বিশেষ দলের বিচার হবে। তাই বিএনপি অভিশংসন বিলে সমর্থন করবে না। এ বিল পাশ হলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
জামায়াত ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল ডা: শফিকুর রহমানও প্রতিবাদ করে বিবৃতি প্রধান করেন এবং আন্দোলনের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, বাকশাল কায়েমের লক্ষেই সরকার সম্প্রচার নীতিমালার পর বিচারপতিদের অভিসংশন সংসদের হাতে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান মন্তব্য করেন, বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়া হলে দেশে আইনের স্বাধীনতা থাকবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। দেশ গণতন্ত্রশূন্যতায় ভুগছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) আ স ম হান্নান শাহ অভিযোগ করেন, সরকার আইন পরিবর্তন করে বাকশালের দিকে যাচ্ছে। সরকার ধাপে ধাপে বাকশাল কায়েমের লক্ষ্যে একটার পর একটা আইন পরিবর্তন করছে। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার কাজে হাত দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার পিতার একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নেই শেখ হাসিনা এখন কাজ করছেন।
তিনি বলেন, সময় আছে জনগণের ভাষা বুঝে সুষ্ঠু নির্বাচন দিন। অন্যথায় আন্দোলনের মাধ্যমে আপনাদের পতন ঘটানো হবে। তখন পালানোর পথ পাবেন না।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে শাস্তি দিতেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপনা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ।
তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীসহ তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সাত হাজার একশটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনেক আসামীকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা অগণিত মামলার একটিও প্রত্যাহার করা হয়নি। উল্টো মামলা দিয়ে আরো হয়রানি করা হচ্ছে।
পূর্বে ব্যারিস্টার রফিকুল বলেন, বিচার ব্যবস্থা চিরতরে অধীনস্ত করতেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা এই একদলীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে সংসদ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে গঠিত নয়, যে সংসদে বিরোধী দল নেই, সে সংসদে এই বিল পাস হতে পারে না। পাস হলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
একইভাবে সমাজের বিশিষ্ট জন, আইজীবীবি ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ড. শাহদীন মালিক, সদস্য সচিব হিসেবে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও সহ-সদস্য সচিব হিসেবে সুব্রত চৌধুরীর নাম ঘোষণা করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এ নাম ঘোষণা করেন। তবে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা এ কমিটিতে থাকবেন না।
পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় বড় করে সংবাদ ছাপানো হয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আইনজীবিরা। কেউ শিরোনাম করেন ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক আইজীবীদের। কিন্তু আমরা এই বিল নিয়ে সরকারের একরোখা মনোভাব দেখলাম। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়ও এই বিষয়ে তার ফেইজবুক পেইজে বিচারপতিদের অভিশংসনের বিলের পক্ষে তার মতামত তুলে ধরেন।
যাচাই-বাছাই শেষে বিলের ওপর সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদীয় কমিটি গত ৯ ও ১০ই সেপ্টেম্বর মাত্র দু’টি বৈঠকেই এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।
এর আগে ২০১১ সালের ৩০শে জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল। বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে ওই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সেদিন বিলটি পাস হয়েছিল। বিলটির পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ২৯১টি, বিপক্ষে ‘না’ ভোট পড়েছিল মাত্র ১টি। নবম সংসদের একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য মো. ফজলুল আজিম ওই ‘না’ ভোটটি দিয়েছিলেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিলটি বাছাই কমিটিতে পাঠিয়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রস্তাব করেন মোট ৮ জন সংসদ সদস্য। এর মধ্যে মো. রস্তুম আলী ফরাজী চলতি বছর ৩০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫ জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন। একই প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র তাহজীব আলম সিদ্দিকী, জাতীয় পার্টির এম এ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী ও মো. আবদুল মতিন এবং বিএনএফ’র এসএম আবুল কালাম আজাদ। এছাড়া তিন সদস্যের কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন জাতীয় পার্টির বেগম রওশন আরা মান্নান। আর ছয়জন সংসদ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিম।
বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, মো. আবদুল মতিন, নুরুল ইসলাম মিলন, পীর ফজলুর রহমান, এম এ মান্নান, বেগম রওশন আরা মান্নান ও ইয়াহইয়া চৌধুরী, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বিএনএফ’র এসএম আবদুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী, হাজী মো. সেলিম ও তাহজীব আলম সিদ্দিকী।
সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪ সম্পর্কে স্থায়ী কমিটির রিপোর্টের ১ দফায় সংশোধনী এনেছেন তিনজন সংসদ সদস্য। এদের মধ্যে রুস্তম আলী ফরাজী বিচারপতিদের বয়স ৭০ বছর করার প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া হাজী মো. সেলিম ও এম এ হান্নান দফা ১-এর ওপর সংশোধনী আনেন। দফা ২-এর ওপর সংশোধনী এসেছে মোট ২৭টি। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী দফা ২ প্রস্তাব করেন, ‘বিচারকদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যরে কোন প্রস্তাব সংসদে উত্থাপিত হলে সংসদের নূন্যতম ১০০ জন সদস্যের উক্ত প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন থাকলে প্রস্তাবটি সরাসরি সংসদ কর্তৃক গঠিত জাজেস ইনকোয়ারি কমিশনে প্রেরিত হবে এবং সংসদ উক্ত কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণিত অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারপতিকে অপসারণ করা যাবে না।’
তিনি দফা (২) এর প্রস্তাবিত উপ-দফা (৪) এর পর নতুন উপ-দফা (৫) সন্নিবেশের প্রস্তাব করেন। রুস্তুম আলী ফরাজী তার প্রস্তাবিত ৫ উপ-দফায় বলেন, এই আইনটি কার্যকর হওয়ার পর অনতিবিলম্বে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগের নীতিমালা তৈরি করার লক্ষে ‘বিচারক নিয়োগ কমিশন’ গঠন করিবেন। এছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, টিপু সুলতান, শেখ হাফিজুর রহমান ও ইয়াসিন আলী এবং নাজমুল হক প্রধান ও শিরীন আখতার বিলের ২ দফায় প্রস্তাবিত উপ-দফা (৩) এর তৃতীয় পংক্তিতে অবস্থিত ‘নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন’ শব্দাবলীর পরে ‘এবং একই সঙ্গে সংসদ বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করিতে পারিবেন’ শব্দাবলী সন্নিবেশের প্রস্তাব করেন।
বিলের ওপর আলোচনায় সংসদ সদস্যরা যা বললেন-
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ সংবিধান সংশোধন বিল প্রসঙ্গে সংসদে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, যদি বলি বিলটি সঠিক তাহলে আমাকে বলা হবো গৃহপালিত। এই সংসদেও রেওয়াজ হয়েছিল যদি ফাইল ছোড়াছুড়ি করতে পারি, তাহলেই সত্যিকারের বিরোধী দল। মানি না, মানবো না, সংসদ বর্জন করি, ওয়াকআউট করি তাহলেই বিরোধী দল!
তিনি আরও বলেন, আমি এই নীতিতে বিশ্বাস করি না। আমি আদর্শের রাজনীতি করি। এই বিলটি পাস হলে স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে কিনা সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিচার বিভাগ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। আমার বিরুদ্ধে ৭০টির বেশি মামলা দেয়া হয়েছে। নীতিগতভাবে আমি এই বিলটি সমর্থন করি।
পরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বিলটিতে সমর্থন দেয়াতে উপস্থিত সংসদ নেতাসহ সবাই টেবিল চাপড়ে উল্লাস প্রকাশ করেন।
বেগম রওশন এরশাদ বলেন, বিলটিতে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তবে এত তাড়াহুড়া করার কোন কারণ ছিল না।
স্বতন্ত্র এমপি হাজী সেলিম সংবিধান সংশোধন বিলটি পাসের আগে বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। এছাড়া বিএনএফ-এর আবুল কালাম আজাদ বিলটির সমর্থন করলেও একই সঙ্গে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাইয়ের প্র্রস্তাব দেন। জাতীয় পার্টির ইয়াহিয়া চৌধুরী তড়িঘড়ি করে বিলটি পাস না করে সংসদের বাছাই কমিটির মাধ্যমে আরও যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব দেন।
জাসদের মাইন উদ্দিন খান বাদল এই বিলটির যারা সমালোচনা করছেন তাদের সমালোচনা করে বলেন, তারা বিরোধিতা করলেও বলছেন না বিলটির কোথায় অসঙ্গতি রয়েছে। তিনি বলেন, জবাবদিহির ঊর্ধ্বে একমাত্র আল্লাহ্। তাই বিলটি জনমত যাচাইয়ে পাঠালেও একই উত্তর ফেরত আসবে।
আইনমন্ত্রী যা বলেন-
আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বিলের সংশোধনী প্রস্তাবের জবাবে বলেন, বঙ্গবন্ধু এই সংবিধান দিয়ে সরকারকে শাসক থেকে সেবকে পরিণত করেছেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই। বিচারকদের আরও সুরক্ষিত করতেই সংশোধনী আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী নতুন আইন করা হবে। এতে বিচারকদের অসদাচরণ ও সামর্থ্যেরও ব্যাখ্যা থাকবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগে কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এই পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে কোন বিচারককে তার পদ হতে অপসারণ করা যাবে বলে বিধান করা হয়। ওই বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, কোন বিচারককে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাকে অপসারণ করা যাবে না। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দু’জন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদ রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের মতো উচ্চ আদালতের বিচারকদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার নীতি বিশ্বের বেশির ভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৬ এর দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ এর পরিবর্তে ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরকে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। উক্ত বিলের ৩ দফা অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সুতরাং ওই আইনে সুনির্দিষ্টকৃত পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকবে না। এমতাবস্থায়, বিলটি আইনে পরিণত হইলে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান হইবে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে বিচারকগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পালনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত রাখতে পারবেন।’
প্রশ্ন হলো, বিষয়টি যেহেতু এতই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে বিশিষ্ট আইনজীবিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের মতামত নিলে কি খুব সমস্যা তৈরী হতো? জনমত যাইয়ের পরামর্শ গ্রহন করলে কি খুব সমস্যা হতো? সবই এড়িয়ে যাওয়া হলো। বিদেশী গনমাধ্যমগুলোর মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ইকনোমিষ্টে এ বিষয়ে বক্তব্য এসেছে- প্রধানমন্ত্রীকে একক ক্ষমতাধর বানানোর জন্যই নীতিমালা, আইন করা হচ্ছে ।
১৯৭২ সালে দেশে ফেরার পর শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবও বিরোধী পক্ষকে স্বমূলে ধ্বংস করে দিয়ে বাকশাল কায়েমের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। চারটি ছাড়া সকল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সকল সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং সেই নিষিদ্ধের ফাঁদে আওয়ামীলীগও পড়েছিলো। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী বাকশাল কায়েমও করেছিলেন। আওয়ামীলীগ শেখ মুজিবের স্বপ্ন পূরণে ৭২এর সংবিধান ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন, অথচ শেখ মুজিবের সর্বশেষ স্বপ্ন ৭২এর সংবিধান ছিল না, ছিল বাকশাল। আসলে আওয়ামীলীগ ভিতরে ভিতরে বাকশালের স্বপ্ন দেখছেন বলে সচেতন মানুষ মনে করেন।
এখন তো আর কথা বলার সুযোগ নাই। কারণ কথা বললে সংবিধানের বিরুদ্ধে বলা হবে। হতে পারে মামলা, হয়রানি, জেল। তাই মনে হয় আন্দোলন ঘোষণাকারীরাও সবাই ইতিমধ্যে চুপসে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করেতে শুরু করেছেন। যাদের হাতে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের মত গুরু দায়িত্ব ছিল, তারাও শেষ পর্যন্ত উপেক্ষিত হলো। উপেক্ষিত হলো জাতি, উপেক্ষিত হলো জনতা। বিজয় হলো সরকারের। বাংলাদেশে যে ভাবে সংশোধন আর পরিবর্তনের রাজনীতি শুরু হয়েছে , তাতে এখন দেখার অপেক্ষা এই বিল কতদিন টিকে থাকে ।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক